পাসপোর্ট সঙ্গে না রেখে কলকাতায় সমস্যার শিকার হচ্ছেন বহু বাংলাদেশি নাগরিক। বিশেষ করে রাতের বেলায়।
মূলত কলকাতার নিয়ম অনুযায়ী, ভারতীয় নাগরিকদেরও তার নাগরিকত্বের পরিচয় সঙ্গে রাখতে হয়। পুলিশের সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। সেই সময় ভারতীয় ব্যাক্তিটি যদি তার সরকারি পরিচয় পত্র (ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড) দেখাতে না পারে তবে পুলিশের নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে।
কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশিরা এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। যে কারণে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অপরদিকে অভিযোগ অনেকেক্ষেত্রে বিদেশি বুঝতে পেরে ভয় দেখানো বা ভুল পথে চালিত করছে কিছু পুলিশের সদস্য।
জানা যায়, সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশিদের পুলিশের বলছে, ‘পাসপোর্ট সাথে নেই? তাহলে সারারাত থানার লকাপে থাকতে হবে। এরপর সকালে কোর্টে তোলা হবে। সেখানেই বাংলাদেশিটি প্রমান হলে তবেই ছাড়া পাওয়া যাবে। ‘
এতেই ভয় পেয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। স্বাভাবিকভাবেই তারা মনে করছেন, কলকাতায় এসে জেলাহাজত বা হয়রানি তাদের বিপদে ফেলতে পারে। ফলে তার থেকে তারা মুক্তির উপায় খোঁজেন। সেই উপায় পুলিশই বলে দিচ্ছে। পরিত্রাণের একটাই উপায় হলো ফাইন। অর্থাৎ পরিস্থিতি বুঝে অর্থ বাগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশিদের থেকে। কারণ এই ধরনের ঘটনায় ফাইন বলে কিছু হয় না।
সেই অর্থের অঙ্ক কখনো ১০ হাজার বা তারবেশি। কখনও আবার পরিস্থিতি বুঝে ৫০০- ১০০০ হাজারেও মিটে যাচ্ছে। বর্তমানের কলকাতার মারক্যুই স্ট্রিটে এই হয়রানির শিকার হচ্ছেন বহু বাংলাদেশি নাগরিক।
কিন্তু ভারতীয় আইন বলছে, প্রতিটি ব্যাক্তিকে তার পরিচয় সঙ্গে রাখতে হবে। সে দেশীয় হোক বা বিদেশি। পুলিশ সন্দেহ বশে যে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। সে সময় সঙ্গে থাকা নথি তার প্রমাণ দেবে তিনি কোন অঞ্চলের নাগরিক।
এই নিয়মে বিদেশিদের জন্য বলা হয়েছে, কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভুলবশত তার সঙ্গে পাসপোর্ট বহন করছে না। তখন পুলিশের প্রধান কাজ হলো বাংলাদেশি বা বিদেশিটি কোথায় উঠেছেন তার খোঁজ নেওয়া। ব্যাক্তিটি যদি নির্দিষ্ট হোটেলে ওঠার তথ্য দেন, তখন পুলিশের প্রথম কাজ হলো ওই হোটেল বা নির্দিষ্ট ভেন্যুতে যাওয়া এবং পাসপোর্টসহ ব্যাক্তিটির সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা। এবং দেখা সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিটি সঠিক তথ্য দিয়েছে কিনা। কিন্তু কোনোভাবেই বৈধপথে আসা নাগরিককে পুলিশ লকাপ বা আদালতে তুলতে পারে না। বরং পুলিশ তাকে সতর্ক করতে পারে যাতে পাসপোর্ট না রাখার ভুল পরবর্তীতে না হয়।
এই তথ্য না জানার কারণে বহু বাংলাদেশি এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। যা নিয়ে বিরক্ত ‘মারক্যুইস স্ট্রিট-ফ্রিস্কুল স্ট্রিট ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’। মূলত বাংলাদেশিদের সহযোগিতার জন্য ওই অঞ্চলে গতবছর তৈরি হয়েছিল এই সোসাইটি। সেই সোসাইটির সাথে যারা জড়িত তারা ওই অঞ্চলের হোটেল ব্যবসাদার, ট্রাভেল, মানি এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির সাথে জড়িত। অর্থাৎ যারা মারক্যুইস স্ট্রিটে নানা ভাবে বাংলাদেশিদের পরিষেবা দিয়ে থাকে।
এই সোসাইটি তৈরি হওয়ার কারণ ছিল, গত বছর মারক্যুইস স্ট্রিট অঞ্চলে বসত রাতের দিকে অস্থায়ী বাজার। যেই বাজারে সবকিছুই মিলত। যেমনটা মেলে ওই অঞ্চলের নিউমার্কেটে। স্থানীয়দের তথ্য মতে, সেই বাজার বসাতো মূলত ভিন এলাকার বাসিন্দারা। এরপরই বহু বাংলাদেশির পাসপোর্ট হারানো, ছিনতাই ইত্যাদির ঘটনা সম্মুক্ষীণ হচ্ছিলেন জানা যায়।
পরে জানা যায় রাতের বাজারের ভিড়ের সুবিধা নিচ্ছিল একদল দুষ্কৃতীরা এবং অন্য এলাকার কিছু সাইকেল রিকশা চালক। তারাই বাজারের ভিড়ে আড়ালে এসব চালতো। এই ঘটনার সামনে আসায় নড়েচড়ে বসেছিল স্থানীয়রা। পুলিশের সাথে একযোগে তৈরি হয় ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। পরবর্তীতে সেই অঞ্চল থেকে তুলে দেওয়া হয় রাতের বাজার। সরিয়ে দেওয়া হয় ভিন এলাকার সাইকেল রিকশাচালকদের। বসানো হয় ৪০টির বেশি সিসি ক্যামেরা।
কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে সর্ষের মধ্যে ভূত বিরাজ করছে। যে কারণে বেজায় চটেছেন ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সদস্যরা। এ বিষয়ে সোসাইটির সদস্য মনোতোষ সরকার বলেছেন, এটা মোটেও ভালো কাজ না। আমরা কয়েকটি ঘটনা জানতে পেরেছি। স্থানীয় নিউমার্কেট থানা, পার্কস্ট্রিট থানা এবং কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর লালবাজারে যোগাযোগ করেছি। তারাও খোঁজখবর নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে আরেক সদস্য মনোতোষ সাহা বলেছেন, মারক্যুইস স্ট্রিট পুরোপুরি বাংলাদেশি নির্ভর। কলকাতায় বাংলাদেশিরা এলে এই অঞ্চলেই ওঠেন। তাদের কারণে এই অঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে থাকে। এমনিতেই ভারতীয় ভিসা না পাওয়ায় বাংলাদেশিরা কম আসছেন। তার উপর এই হয়রানির শিকার হলে তা লজ্জাজনক। এটা মোটেই বরদাস্ত করা যাবে না।
সে অঞ্চলের বাংলাদেশিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাত সাড়ে ১০- ১১ টার পর তারা যখন ভাতের হোটেলগুলো থেকে খেয়ে বের হচ্ছেন, তখনই পুলিশ হয়রানি করছে। পুলিশ তাদের প্রথমেই জিজ্ঞেস করছে, কোথায় থাকেন? পরিচয়ে বাংলাদেশি বলা হলে, পুলিশ পাসপোর্ট দেখতে চাইছে। বাংলাদেশিরা পুলিশকে বলছে, রাতে খেতে বাহির হয়েছিলাম, পাসপোর্ট সাথে নেই। তখনই পুলিশ বলছে, গাড়িতে উঠে বসুন। থানায় যেতে হবে। এই শুনে অনেকেই ভয় পেয়ে মুক্তির অন্য উপায় খোঁজে। তখনই সেই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফাইনের নামে অর্থ হাতানো হচ্ছে বলে জানা যায়।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক ২৫ ঊর্ধ্ব নারায়ণগঞ্জের এক বাসিন্দা বলেছেন, রাতের বেলা বাবাকে নিয়ে খেতে বাহির হয়েছিলাম। তারপরই এই হয়রানির শিকার হই। পরে বাকবিতণ্ডা বেঁধে যাওয়ায় আমাকে এবং আমার বাবাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। দীর্ঘ এক ঘণ্টা পুলিশের গাড়িতে আমাদের ঘুরতে হয়। পরে বেগতিক দেখে আমি বলি, কি করতে হবে বলুন। বাবা অসুস্থ আমাদের ছেড়ে দিন। তখন পুলিশ দশ -দশ করে বিশ হাজার রুপি চায়। পরে ১২ হাজার নিয়ে আমাদের কিড স্ট্রিটে(ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম) নামিয়ে দিয়ে যায়।
একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কলকাতায় ভ্রমণে আসা তিনজন ঢাকাবাসী। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তারা রাত বারোটার পর মির্জাগালিব স্ট্রিটে পায়ে হেঁটে বেড়াতে যান। ঠিক ১২:৪০ নাগাদ একটি পুলিশের গাড়ি তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং তিনজন পুলিশ সে গাড়ি থেকে নেমে তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে।
এরপরই একইভাবে তাদের কাছ থেকে ফাইনের নামে মাথাপিছু ২ হাজার রুপি করে চাওয়া হয়। কিন্তু তা না মানায় একই ভয় দেখানো হয় তাদেরকেও। তারা বলেন, এত টাকা সাথে নেই। হোটেলে গেলে দিতে পারবে। তাতে নারাজ তারা। ওখানেই ফয়সলা করতে হবে পুলিশের গাড়িতে উঠতে বলে হুমকি দেয় বলে জানান ওই তিন বাংলাদেশি।
অবশেষে কলকাতার পরিচিত এক ব্যক্তির সাথে তারা ফোনে যোগাযোগ করে। পরে পরিচিতি ব্যাক্তির সাথে পুলিশ কথা বলিয়ে দেয়। এরপরই তারা বিনা অর্থে পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু সকলের তো কলকাতায় পরিচিতজন থাকে না। ফলে বহু বাংলাদেশি সমস্যায় পড়ছে বলে অভিযোগ ঢাকার বাসিন্দার।
কলকাতা হাইকোর্টের উকিল শুভজিৎ চক্রবর্তী বলছেন, অবশ্যই স্থানীয় বা বিদেশি যেই হোক না কেনো তার পরিচয় পত্র পকেটে রাখা উচিত, এটাই নিয়ম। আর বিদেশে ভ্রমনে গেলে পাসপোর্ট হাতছাড়া করা চলবে না। যখনই ভারত তথা কলকাতার সড়কে কোনো বাংলাদেশি পা রাখবেন সাথে পাসপোর্ট রাখতে হবে।
তবে পুলিশ সহযোগিতা না করে সমস্যা সৃষ্টি করার বিষয় আইনজীবী বলেছেন, অবশ্যই এটা লজ্জার বিষয়। তবে সব পুলিশ সমান নয়। এই পুলিশ যেমন আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। তেমন তাদের নিরাপত্তায় বাংলাদেশিরাও কলকাতায় নিরাপদে থাকে। এমন বহু উদারহরণ আছে। ফলে সবাই সমান নয়। তবে যা হচ্ছে তাও বাঞ্ছনীয় নয়।