অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি ‘বাঘা সিদ্দিকী’ নামে পরিচিতি পান। তাকে বঙ্গবীর নামেও ডাকা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি রাস্তায় নেমে আসেন। কিছু সময়ের জন্য গড়ে তোলেন সশস্ত্র প্রতিরোধ। তার সেই ভূমিকা ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে তিনি যুগান্তরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ রশীদ ও খালিদ বিন আনিস
যুগান্তর : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর যখন আপনি শুনলেন, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আপনার প্রথম অনুভূতিটা কেমন ছিল?
কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম : আপনারা এখন যে ঘরে বসেছেন, আমি এখানেই রাতে থাকতাম। তখন এ বাড়ির ঘরগুলো ছিল ছোট ছোট। এখানে আমি শুয়ে থাকতাম। যা হোক, সেই সময়কে বিচার করতে গেলে তখন একটা নতুন পরিবর্তন এসেছিল। স্বাধীন দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে সংসদ-সদস্যকে ঈদের মাঠে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। খুব সম্ভবত মোতাহার মাস্টার অথবা লালমোহন। এভাবে চারজন এমপিকে মারা হয়েছিল সে সময়। না হলেও দু-তিন হাজার আওয়ামী লীগের লোক মারা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু একসময় নিরুপায় হয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। একটা সময় এটি বাকশাল হিসাবেই বেশি পরিচিতি পায়। আওয়ামী লীগ আর কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নামে কাছাকাছি মনে হতে পারে; কিন্তু পরিকল্পনা ও কর্মের দিক থেকে এ দুটির অনেক ভিন্নতা ছিল। বঙ্গবন্ধু প্রশাসনযন্ত্রকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে চেয়েছিলেন, ক্ষমতাকে কুক্ষিগত না করে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্যই তিনি গভর্নর পদ্ধতি চালু করেছিলেন। যদি বঙ্গবন্ধু তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারতেন, তাহলে এখন আমরা পৃথিবীর মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ দেশ হিসাবে পরিগণিত হতাম। কোনো প্রোগ্রাম, বিশেষ করে জাতীয় উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা, যদি সফল না হয়ে বিফল হয়, তখন তার অনেক রকমের সমালোচনা হয় এবং বঙ্গবন্ধুর মতো এত উচ্চমানের একজন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতা, তিনি যখন এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তখন মানুষের প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশাই সাধারণ মানুষ করেছিলেন; কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। পূরণ হয়নি বলেই যা নয়, তা-ও বলা হচ্ছে। আপনি বলছেন আমার কেমন লেগেছিল? আসলে আমি বোধহয় সর্বশেষ ব্যক্তি, যে বঙ্গবন্ধুকে সেই রাতে দেখেছিলাম, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটা দেশের কোনো মানুষই কল্পনা করেনি এবং আমিও কল্পনা করিনি।
যুগান্তর : কোনো আলামত পাননি?
কাদের সিদ্দিকী : বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার দু-তিন মাস আগে থেকে না হলেও তিন-চারশ চিঠি পেয়েছি, ফোন এসেছে। এটা নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথাও বলেছি। আমার জন্য তার দ্বার সবসময় খোলা ছিল। আর আমি কোনো দিনই কোনো কিছু বলতে দ্বিধা করতাম না। কারণ, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আমার আর্থিক কোনো কিছুই চাওয়ার ছিল না। যা চাওয়ার ছিল সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রের কল্যাণে।
যুগান্তর : বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে একরকম ষড়যন্ত্রের কথা অনেকে বলেন।
কাদের সিদ্দিকী : হ্যাঁ, ষড়যন্ত্র। আপনাকে ভাবতে হবে, মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থন করেছে দেশ হিসাবে ভারত। একটা সময় এসে, আগস্ট মাসের পর থেকে সমর্থন দেয় রাশিয়া। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তাদের ভূমিকা আমাদের পক্ষে খুবই কার্যকর ছিল। আর একটা দেশ ভুটান। খুব ছোট দেশ। বাংলাদেশকে কিন্তু ভুটানই সবার আগে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতির দিক থেকে ভারত হচ্ছে দ্বিতীয়। যদিও ভারতই আমাদের যথার্থভাবে সাহায্য করেছে। তো সেজন্য এটা ভেবে দেখা দরকার, পুরোপুরি ষড়যন্ত্র না হলে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ মারা যাবেন কেন। এর কদিন আগেই চিলির আলেন্দে নিহত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু কয়েকটা বক্তৃতায় বলেছিলেন, বিশ্ব এখন দুই ভাগ, আমি গরিবের পক্ষে। যদি চিলির আলেন্দের মতোও জীবন দিতে হয়, তবুও আমি গরিবের গণতন্ত্র, সাধারণ মানুষের গণতন্ত্রের পক্ষে থাকব। আরব দেশগুলোও আমাদের পক্ষে ছিল না। তারা সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আমেরিকা-চীন আমাদের বিরুদ্ধে। আমেরিকা যদিও স্বাধীনতার পরপরই স্বীকৃতি দিয়েছিল, চীন কিন্তু বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালীন স্বীকৃতি দেয়নি। তো এজন্য এটাকে ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কী বলব? আমেরিকার তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার স্বাধীনতার পর একসময় বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ হওয়া-এটা পাকিস্তানের পরাজয় নয়, এটা আমার কূটনীতির পরাজয়। এরপর তো ষড়যন্ত্রের কথা বলে খুব একটা লাভ নেই। বঙ্গবন্ধু যদি না বলতেন, পৃথিবী দুই ভাগ-একটা শোষক, আরেকটা শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে; তিনি পুরোপুরি যদি শোষিতের পক্ষে না থাকতেন, তিনি যদি এটা মুখে বলতেন, কাজে অন্য কিছু করতেন, তাহলে মারা যেতেন না।
বঙ্গবন্ধু একসময় ছিলেন বাংলাদেশের সবার প্রিয় মানুষ, কাঙ্ক্ষিত মানুষ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যখন মারা গেলেন, তখন আমাদের শত্রুরা খুব বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধে যারা হেরে গিয়েছিলেন, তারা সত্যিকারভাবে হারেননি। তারা যুদ্ধে হেরেছিলেন, কিন্তু কূটনীতিতে হারেননি। বাংলাদেশে পাকিস্তানের যারা এজেন্ট ছিল, সেটা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাইকেই বলা যায়, তারা কিন্তু বাংলাদেশ হওয়ার পরও পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করেছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে পাকিস্তানের এজেন্ট ছিল, ব্যবসায়ীদের মধ্যে ছিল, সাংস্কৃতিক দলের মধ্যে ছিল। আমরা বাংলাদেশ বানিয়েছি বলেই তারা একদিনেই পাকিস্তান থেকে সরে আসবেন, এটা বিশ্বাস করা যায় না। না হলে জুলফিকার আলী ভুট্টো যেদিন এসেছিলেন, সেদিন বিমানবন্দর থেকে তাকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, রাস্তার দুপাশে যে পরিমাণ লোক দাঁড়িয়েছিল-তা থেকে বোঝা যায়, একদিনেই পাকিস্তানি মনোভাব শেষ হয়ে যায়নি। আমরা সেটাকে খুব শক্তভাবে ধরতে পারিনি বা ধরিনি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসেই সবাইকে মাফ করে দিয়েছিলেন। অনেকে বলবে, আমরা টিকে থাকতে পারলে এ মাফ করে দেওয়াটা হতো দাতা হাজি মুহম্মদ মহসিনের চেয়েও উদার। তবে এটা সত্যি, যাদের নামে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, তাদের মাফ করা হয়নি। আজকে অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সময়টা ছিল খুব কঠিন।
যুগান্তর : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর একমাত্র আপনিই জোরালো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এবং রাস্তায় নেমেছিলেন। তো সেই সময় অন্যরা কেন রাস্তায় বের হলো না?
কাদের সিদ্দিকী : আমি রাস্তায় বেরিয়েছিলাম, কারণ আমার মনে হতো, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে, তারা কেন আমাকে হত্যা করবে না? দেশের মানুষ আমাকে যতটা শেখ মুজিবের কাছাকাছি আপনজন ভাবে, আর আমি তার জন্য যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছি, যেভাবে তার কথাকে মূল্য দিয়েছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, আমাকে যদি হত্যা না করে, তাহলে আমার মধ্যে কোনো গলদ আছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড আমি মনেপ্রাণে এতটুকু মানতে পারিনি। দেশের মানুষের প্রতি তখন ভরসা ছিল আরও অনেক বেশি। যদি ষড়যন্ত্রকারীরা এবং খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের কেবিনেটকে তার কেবিনেট না করতেন বা করতে না পারতেন, তাহলে এ খুনিরা ছয় বছর থাকত না। মানুষ ভয় পেয়েছে এবং এরা মন্ত্রিসভায় যাওয়ায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। তাই সব জায়গায় মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারেনি সঙ্গে সঙ্গে। দেশের মানুষ আমাকে শেখ মুজিবের পোলা মনে করত, এখনো করে। তো সেজন্য পুত্র হিসাবে আমার যা করার আমি করেছি; আমার কাছে ভীরুতা, কাপুরুষতা মৃত্যুর শামিল।
যুগান্তর : যখন আপনি বের হলেন, আপনার পাশে কাদের পেয়েছিলেন?
কাদের সিদ্দিকী : অনেক মানুষ পেয়েছি। তবে নেতৃস্থানীয় কাউকে পাইনি।
যুগান্তর : এটা নিয়ে কখনো আপনার মনে প্রশ্ন আসেনি?
কাদের সিদ্দিকী : আসে, এখনো আসে, সবসময়ই আসে।
যুগান্তর : তো এতদিন পর আপনার কাছে কী জবাব আছে? যারা বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের ছিলেন, মন্ত্রিপরিষদে ছিলেন, আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য হিসাবে ছিলেন, তাদের অধিকাংশেরই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যখন হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন, অধিকাংশই কিন্তু মন্ত্রিসভা ছেড়ে পরবর্তীকালে নতুন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন। এরকম একটা অবস্থার পর আমরা অনেককেই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে, এমনকি এখনো তাদের দেখতে পাচ্ছি। এটা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও একদিন এক সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এতদিন পরে বিষয়টি নিয়ে আপনার হিসাব-নিকাশটা কী?
কাদের সিদ্দিকী : আমার অনুভূতি হচ্ছে, তখন আমিও ক্ষুব্ধ হয়েছি। কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে তাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় আসে যখন নিজের কিছুই করার থাকে না।
যুগান্তর : আপনি তো নেমেছিলেন রাস্তায়।
কাদের সিদ্দিকী : আমি তো তখন অত বড় ছিলাম না। আমি যদি তখন অত বড় হতাম, তাহলে আমিও হয়তো মন্ত্রিসভায় যেতাম। আসলে কেউ যায়নি, তাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আর সেই অবস্থাটা মানে বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার পরের অবস্থাটা আপনারা কেউ অনুভব করতে পারবেন না। সেজন্য আপনারা হয়তো মনে করতে পারেন, ওরা অপরাধ করেছেন। নিশ্চয়ই অপরাধ করেছেন; কিন্তু সেই অপরাধ খুব বড় মাপের নয়।
যুগান্তর : পরবর্তী সময়ে অনেককে আওয়ামী লীগে স্থান দেওয়া-এগুলো কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
কাদের সিদ্দিকী : কিছু কিছু তো ভুল আছেই। বড় দল ভুলও করে।
যুগান্তর : এ সূত্র ধরেই যদি জানতে চাই, আমরা জেনে এসেছি জাতীয় চার নেতা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যেতে রাজি হননি। এ কারণেই কি তাদের প্রাণ দিতে হয়েছে? তো এ সাহসটা কি অন্য নেতাদের মধ্যে ছিল না?
কাদের সিদ্দিকী : অন্য নেতাদের সে সুযোগ ছিল না। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে শপথ করানো হয়েছে। খন্দকার মোশতাক এমপিদের ডেকেছিলেন। তাতে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। কিন্তু তাদের অনেকেই মনে করেছিলেন, সামনাসামনি ওকে চ্যালেঞ্জ করবেন। এখন যিনি আইনমন্ত্রী, আনিসুল হক-তার বাবার নাম সিরাজুল হক। এ সিরাজুল হক কিন্তু তা করেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাকে প্রেসিডেন্ট মানি না, তুমি খুনি। কিন্তু সন্ধ্যায় যে নিউজ বের হয়-সব এমপি মোশতাককে সমর্থন দিয়েছে। আসলে পাঁচজন এমপিও তাকে সমর্থন দেয়নি। কিন্তু গণমাধ্যম তখন তাদের (খন্দকার মোশতাক) হাতে। তারা প্রচার করেছে, সবাই সমর্থন দিয়েছে। এটা কৌশল, আওয়ামী লীগের নেতারা কিছু সময়ের জন্য কৌশলের কাছে হেরে গেছেন।
যুগান্তর : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আপনি যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, সে বিষয়ে একটি আমেরিকান ডকুমেন্টে আমরা কিছু তথ্য পেয়েছি। সেখানে বলা হয়েছে : পঁচাত্তরের অক্টোবরে পাবনা জেলার ব্রহ্মপুত্রের এক চরে সশস্ত্র লোকের সঙ্গে সংঘর্ষের পর পুরো দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা টাইগার কাদের সিদ্দিকীর ওপর। পার্শ্ববর্তী টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মার্কিন কূটনীতিকদের বাঙালি রাজনৈতিক সহকারীদের কাছে জানান, অভ্যুত্থানের পর থেকে কাদের সিদ্দিকীর অনুসারীদের একটি দল এ এলাকায় তৎপরতা চালাচ্ছে। ১২ অক্টোবর টাঙ্গাইলে সামরিক বাহিনীকে জানানো হয়, তাদের হিসাবমতে ২০০ লোকের একটি দল ব্রহ্মপুত্রের এক চরে আত্মগোপন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী আক্রমণ চালানো হয়, এক প্লাটুন সৈন্য হেলিকপ্টারে করে চরে পৌঁছায়। আর এক প্লাটুন নৌকায়। হেলিকপ্টারটি প্রথমে চরে অবতরণের পরপরই চোরাগোপ্তা গুলিবর্ষণের মুখে পড়ে। সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও দুজন সৈন্য নিহত হন। এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
কাদের সিদ্দিকী : এসব সত্য, তবে নিহতের সংখ্যা কম দেওয়া হয়েছে। জায়গাটার নাম নিশ্চিন্তপুর। ওই সংঘর্ষে দুজন নয়, মারা গিয়েছিলেন আর্মির সাতজন। আহত হয়েছিলেন পাঁচ-ছয়জন। যে ক্যাপ্টেন মারা গিয়েছিলেন, তিনি ও তার পরিবার আমারই পাশের এক বাসায় থাকতেন। আমার পরিবারের সদস্যদেরও সেখানে যাতায়াত ছিল। তো লাশ যেদিন আনা হয়, তা দেখে সেই পরিবারের সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন সেখানে আমার ভাইপো ছিল, বোনেরাও ছিল। আমার বোনেরা তাদের আশ্বস্ত করে বলেছে, তোমরা চিন্তা করো না, ওর কপালে এটা ছিল। বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরেছে, এটা তাদের শাস্তি।
যুগান্তর : এমন সাহস কেন আর কেউ দেখাতে পারেনি?
কাদের সিদ্দিকী : যারা সাহস দেখাতে পারেনি, তাদের জিজ্ঞেস করেন।
যুগান্তর : এ ব্যাপারে আপনার কোনো মূল্যায়ন আছে কি?
কাদের সিদ্দিকী : আমার কোনো মূল্যায়ন নেই। আমি কাউকে ঘৃণা করি না, তবে ব্যর্থ মনে করি। অবশ্য কোনো মানুষের ব্যর্থতার জন্য সে সারা জীবনের জন্য কলঙ্কিত, এটা ঠিক নয়। আমার মধ্যে এ অনুভূতিটাই কাজ করে যে, যখন যে যতটা সার্ভিস দিতে পেরেছে, ওটাই যথেষ্ট।
যুগান্তর : যখন কিলিং অপারেশনটা হলো, অনেকেই ভেবেছিলেন, আর্মি যদি নাও নামতে পারে, অন্তত রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে। কিন্তু তেমন কিছু আমরা দেখিনি। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?
কাদের সিদ্দিকী : যেখানে সেনাবাহিনী বের হয়নি, বিডিআর বের হয়নি, সেখানে রক্ষীবাহিনীর কাছ থেকে এমনটা আশা করা যায় না। সব সশস্ত্র শৃঙ্খলা বাহিনী হুকুমে চলে। ছাত্রদের মধ্যে যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘মানি না, মানব না’ বলে কোনো মিছিল বের করা সহজ, শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর সে সুযোগ নেই। আর রক্ষীবাহিনীর যে সামর্থ্য, যে ট্রেনিং, যে অস্ত্র, তা দিয়ে ট্যাংককে মোকাবিলা করার কোনো ক্ষমতা ওদের ছিল না। আরও মজার কথা যে, এতবড় একটা বাহিনী, তাদের অস্ত্রাগার ছিল না। তাদের অস্ত্র পিলখানায় বিডিআরের হেফাজতে থাকত। তো এসব নানা দিকে আমাদের অনেক ব্যর্থতা আছে।
যুগান্তর : এ দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আপনার যে চেতনা, দেশকে স্বাধীন করার দুর্বার আকাক্সক্ষা থেকে আপনি ইতিহাস রচনা করেছেন, এ সময়ে এসে কী মনে করেন? কতটুকু ফল মিলেছে?
কাদের সিদ্দিকী : খুব একটা মেলেনি। খুব একটা চাহিদা পূরণ হয়নি। এটা স্বাধীনতার বছরখানেক পর থেকেই।
যুগান্তর : মানে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকাকালীনই?
কাদের সিদ্দিকী : অবশ্যই, এ নিয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে বেশ কয়েকবার বলেছি। তিনি বলেছেন, আমিও তোর মতো মর্ম যাতনায় ভুগি; কিন্তু একদিনে তো সব পরিবর্তন করা যাবে না।
যুগান্তর : সেই পরিবর্তন তিনি চলে যাওয়ার পর থমকে গিয়েছিল; কিন্তু এর পরে কি তা সাধন করা গেছে?
কাদের সিদ্দিকী : না, শেখ মুজিব যখন ছিলেন, তিনি যা করেছেন, বাংলাদেশে আর কারও পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয়নি।
যুগান্তর : তাহলে এ দেশের ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?
কাদের সিদ্দিকী : ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু আমার কোনো হতাশা নেই। বাংলাদেশের সৃষ্টি ছিল একটা দিক। পশ্চিমাদের দাস হয়ে থাকার চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ হয়ে না খেয়ে থাকা অনেক ভালো। বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে এটাই ছিল আমাদের চেতনা। আরেকটা কথা জোর দিয়েই বলা যায়, ওরা পাকিস্তানের বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল। আমি আগেও বলেছি, যুদ্ধে পাকিস্তানিরা হেরেছে; কিন্তু কূটনীতিতে তারা জিতেছে। এখানে তাদের যে দালাল-টালাল ছিল, তারা পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের কাছ থেকে যা পেয়েছে, পরবর্তীকালে তার চেয়ে বেশি পেয়েছে। এ পাওয়ার কারণেই তারা অনেক শক্তিশালী হতে পেরেছিল।
যুগান্তর : বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর অর্থাৎ পঁচাত্তরের পর বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার যে চেষ্টা, জাতীয় মর্যাদার আসন থেকে সরিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা হয়েছিল, আবার যদি ক্ষমতায় স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কোনো দল আসে, সে চেষ্টা কি আবারও হবে?
কাদের সিদ্দিকী : অবশ্যই, এতে কোনোরকম সন্দেহ থাকার কথা নয়। যত দিন গেছে, সামাজিক মূল্যবোধটা তত নষ্ট হচ্ছে। আমরা এখন সুপ্রিমকোর্টেও মারামারি করতে দেখি; কিন্তু আমাদের কাছে বিচারালয় ছিল একেবারে পবিত্র, মসজিদ-মন্দিরের মতো পবিত্র। কিন্তু এখন কী অবস্থা? রাজনৈতিক ভারসাম্য নেই। যদি রাজনৈতিক ভারসাম্য থাকত, রাজনৈতিক চেতনা থাকত, তাহলে অন্য দল ক্ষমতায় এলে তারাও বঙ্গবন্ধুর কথা বলেই আসত। আসলে বঙ্গবন্ধু এ দেশের সবার হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আমরা সেটা করতে পারিনি, হতে পারিনি।