বিএনপির পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোকেও প্রাধান্য দিচ্ছে অন্যতম প্রভাবশালী দেশ চীন। অথচ গত দেড় দশকে পর্যায়ক্রমে একাধিকবারের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কে অনেকটা ছেদ পড়েছিল দেশটির। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনীতির পাশাপাশি কূটনৈতিক দৃশ্যপটও পাল্টে যায়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন ঢাকাস্থ চীনের রাষ্ট্রদূত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীন মনে করছে শেখ হাসিনার পলায়ন ও আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিতায় দেশটির ভিন্ন বন্ধু দরকার। যে কারণেই বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে সম্পর্কোন্নয়নে প্রাধান্য দিচ্ছে চীন। সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী দলের নেতারা গত বছরের নভেম্বরে পৃথকভাবে চীন সফর করেছেন। এবার চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাবে। এবার চীন সফরের তালিকায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হকের নামও রয়েছে। সফরসূচি চূড়ান্ত না হলেও শিগগিরই নেতারা দেশটিতে যাবেন। পাশাপাশি বিএনপি এবং বিভিন্ন দলের কয়েকজন নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনবারের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী দল বিএনপি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছর শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ ক্ষমতাধর কয়েকটি দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। তা ছাড়া সময়ের ব্যবধানে নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী চীনের কাছেও গুরুত্ব বেড়েছে বিএনপির। সম্প্রতি দলটির সঙ্গে চীনের নানামুখী কর্মতৎপরতায় বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চীনও চাইছে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করতে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম মনি কালবেলাকে বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে চীন উপলব্ধি করেছে যে, শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয়, বরং দেশের জনগণের সম্পর্ক গড়া জরুরি। সে জায়গা থেকে চীন মনে করে বিএনপি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, সে জন্যই বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায় তারা। আর বিএনপিও বাংলাদেশের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। কেননা, পৃথিবীতে সব পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্কটা হয় স্বার্থের ভিত্তিতে। প্রতিবেশী একজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ভালো—সেটা বন্ধু হতে পারে, শত্রুও হতে পারে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে বিএনপির সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্ট হতে শুরু করে। এক দশকের বেশি সময় পর ২০২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চীনের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। রাজধানীর হোটেল লা-মেরিডিয়েনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ নেতারা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
এর আগে গত বছরের ২১ আগস্ট ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে মির্জা ফখরুলসহ দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। দেড় ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠকে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সঙ্গে চীনের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও গভীর হবে। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, ওয়ান চায়না পলিসিতে বিএনপি সবসময় বিশ্বাস করে এসেছে, আমরা এখনো সে ঘোষণা আরও দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই।
বৈঠক শেষে চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছিলেন, আমরা আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা এবং পর্যালোচনা করেছি। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও বিএনপি একসঙ্গে কাজ করতে চায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে ২০১৬ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বৈঠক হয়। ২০১৪ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে বিএনপির ১১ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। এর পরের বছর আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল চীন সফর গেলেও বিএনপি আমন্ত্রণ পায়নি। ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে আবারও চীন সরকারের আমন্ত্রণে যান বিএনপির তিন নেতা। মূলত ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে চীনের সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। ২০২১ সালে চীনের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়। তবে বিএনপির প্রতিনিধিদলের সফরের পর সেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।
অবশেষে শেখ হাসিনার পতন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলের পর ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে দেশটি সফরে যায় বিএনপির চার সদস্যের প্রতিনিধিদল। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপনের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদা হাবিবা। সফর শেষে ১৬ নভেম্বর তারা দেশে ফেরেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু কালবেলাকে বলেন, বিএনপি কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়, সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়। শেখ হাসিনার পতনের পর বিদেশি রাষ্ট্রগুলো স্বাভাবিকভাবে কূটনীতিতে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। বিশেষ করে প্রভাবশালী দেশগুলোর আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে। সে জায়গা থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী চীন মনে করে, বিএনপি আগামীতে সরকারে থাকবে। এ জন্য অন্যতম প্রভাবশালী দেশ চীন বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মনে করেন বিএনপির এই নেতা।
শিগগিরই চীন যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের ১৫ নেতা: খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি ফেব্রুয়ারির যে কোনোদিন বিএনপির সাত সদস্যের এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর আটজনসহ মোট ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাবে। এরই মধ্যে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের প্রয়োজন অনুসারে ভিন্ন দুটি তালিকা জমা দেওয়া হয়েছে। উভয় তালিকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষর রয়েছে। বিএনপির তালিকায় রয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, নূরুল ইসলাম মনি, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নয়ন, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা।
জানতে চাইলে সৈয়দ এহসানুল হুদা গতকাল কালবেলাকে বলেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধিদল চীন সফরে যাবেন বলে শুনেছি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত সফরসূচি এখনো নির্ধারিত হয়নি। তিনি বলেন, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।