৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের সর্বত্র চলছে সংস্কার ও পরিবর্তনের তৎপরতা। তবে এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম শিক্ষা প্রশাসন। সম্প্রতি শিক্ষার বিভিন্ন দপ্তরে পদায়ন-পদোন্নতি কার্যক্রম চললেও তাতে সুযোগ পাচ্ছেন না বিগত সময়ে বঞ্চিতরা। বরং আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগীদেরই দৌরাত্ম্য দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে নতুন করে বঞ্চনার পাশাপাশি ঠুনকো অজুহাতে শাস্তির মুখে পড়ছেন অনেকে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে চরম ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের সময়ে শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টদের নিয়োগ পাওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িতরাই গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগ পেতেন।
অথচ বিগত সময়ে যারা বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাই আবার ঘুরেফিরে বড় পদগুলোতে নিয়োগ পাচ্ছেন। অন্যদিকে ঠুনকো অজুহাতে বঞ্চিতদের নতুন করে বঞ্চনার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখে পড়তে হচ্ছে।
এ বিষয়ে পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা মর্যাদা রক্ষা কমিটির সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদায়নে শিক্ষা ক্যাডারের ন্যূনতম নীতিমালাও মানা হচ্ছে না।
বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী ও সহচরদেরই মাউশি, এনসিটিবি, নায়েম, শিক্ষা বোর্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে জুলাই বিপ্লবে ছাত্ররা যে জন্য রক্ত দিয়েছিল, তার সঙ্গে বেঈমানি করা হচ্ছে।
এক সপ্তাহের ব্যবধানে শাস্তিমূলক তিনটি আদেশের চিঠি পেয়েছেন ২৫ ক্যাডারের সংগঠন আন্তঃক্যাডার নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ও তিতুমীর কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মফিজুর রহমান।
সর্বশেষ গত ২৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমানকে। প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিধিমালা অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ তার চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা প্রয়োজন ও সমীচীন মনে করেন।
এ বরখাস্তের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ড. মফিজুর রহমান। তিনি আমার দেশকে জানান, ২০১৪ সাল থেকে তিনি ঢাকার বাইরের কলেজে নিয়োজিত ছিলেন। ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের আগ্রহে গত বছরের ১৮ নভেম্বর রাজধানীর তিতুমীর কলেজে বদলি করা হয় তাকে। অথচ কিছুদিনের মাথায় তাকে ওএসডি ও সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।
তিনি বলেন, বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে কথা বলার কারণে আক্রমণের শিকার হয়েছেন তিনি। তার বাড়ি গিয়েও নানা খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে আগে যারা বিভিন্ন পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন, এখনো তারা যে যেভাবে পারছেন সরকারকে বুঝিয়ে পদ বাগাচ্ছেন।
ড. মফিজুর রহমান আরো বলেন, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনই শিক্ষা ক্যাডারের। অথচ একই ধরনের মন্তব্য করেছেন অ্যাডমিন ক্যাডারের ২২ জন। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে শিগগিরই তারা কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
জানা গেছে, গত রোববার শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যাপক ড. এহতেসাম উল হক।
আর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক পদে পদায়ন পেয়েছেন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. জুলফিকার হায়দার। এ দু’জনই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগের মতাদর্শের বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের এ নিয়োগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ ও তা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির সদস্যরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ দাবির কথা জানান তারা। এ সময় সচিব তাদের জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এতে তারা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী ছিলেন—এমন কোনো তথ্য আসেনি।
একইভাবে ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং এনসিটিবির শীর্ষ বিভিন্ন পদে ফ্যাসিবাদের সহযোগী এবং নানাভাবে আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগীরাই নিয়োগ পাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।