ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সব তথ্য ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে জমা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের সব ডাটা এখন রয়েছে ভারতীয় সার্ভারে।
শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পার হলেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো পুরোটাই ভারত ও ফ্যাসিবাদের দোসর শেখ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার নানা অপকৌশলে খাতটি শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সরাসরি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়।
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সব তথ্য ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে জমা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের সব ডাটা এখন রয়েছে ভারতীয় সার্ভারে। এতে জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনে তথ্যপ্রযুক্তি খাত ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)। এজন্য বিটিআরসি সে সময় নানা অজুহাত তৈরি করে। সাবমেরিনের বিকল্প প্রয়োজনের কথা বলে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি)। এর মাধ্যমে ভারতনির্ভর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি তিনটি প্রাইভেট সাবমেরিনের অনুমোদনও দেয় হাসিনার সরকার। এগুলোর মালিকানা দেওয়া হয় সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ও সামিট গ্রুপকে। কোম্পানি তিনটিকে ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয় ২০৪২ সাল পর্যন্ত। বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চুক্তি বাতিল না হলে তাদের হাতেই থাকবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশ ২০০৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল এসএমডব্লিও-৪-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে সাবমেরিন ক্যাবলের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় সরকার ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) হিসেবে পরিচিত।
সূত্র বলছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবায় বিদ্যমান সাবমেরিন কোম্পানির যথেষ্ট সক্ষমতা ছিল। শুধু ভারতকে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিতে বিকল্প সরবরাহকারীর অজুহাত তোলা হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পরই বিকল্প ক্যাপাসিটি সরবরাহকারী তৈরি করার নামে ২০১২ সালে বিটিআরসি নতুন পাঁচটি প্রাইভেট অপারেটরকে লাইসেন্স দেয়। এগুলো ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল অপারেটর (আইটিসি) হিসেবে পরিচিত। এগুলো সাবমেরিনের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে শুধু ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে।
আইটিসির আওতায় রয়েছে ফাইবার@হোম, সামিট কমিউনিকেশনস, নভোকম, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশন, বিডি লিংক কমিউনিকেশন এবং ম্যাংগো টেলিসার্ভিসেস। আইটিসি নিয়ন্ত্রিত সব প্রতিষ্ঠানই ভারতের বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানি থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে।
বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইটি খাত ভারতের নিয়ন্ত্রণে দিতে আইটিসির মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্নভাবে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন আইটিসির রেভিনিউ শেয়ার হচ্ছে এক শতাংশ। আর সাবমেরিন সংযুক্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডকে (বিএসসিসিএল) দিতে হয় তিন শতাংশ রাজস্ব। এ ছাড়া শুরুতে আইটিসির ব্যান্ডউইথ লিমিট দেওয়া হয় পুরো চাহিদার ৬০ শতাংশ। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই বিটিআরসি এ নির্ধারিত সীমাও তুলে দেয়। এতে অবারিতভাবে আইটিসির আওতায় অনুমোদন পাওয়া ভারতনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ডউইথ সরবরাহের ক্ষমতা লাভ করে।
এদিকে রাজস্ব শেয়ার তিন শতাংশ বহাল রেখেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডকেও (বিটিসিএল) আইটিসি লাইসেন্স দেওয়া হয়। মূলত ভারতকে আইটি খাত নিয়ন্ত্রণে দিতেই আইটিসির রাজস্ব শেয়ার এক শতাংশ করা হয়। সাব মেরিনের মতো বিএসসিসিএলের রেভিনিউ শেয়ার তিন শতাংশ বহাল রেখেই দুই বছর পর বিটিসিএলকেও আইটিসির লাইসেন্স দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল এসএমডব্লিও-৫-এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এতে শুধু সাবমেরিন ক্যাবলে মোট ব্যবহারযোগ্য ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতা দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৮৫ টেরাবাইট পার সেকেন্ড (টিবিপিএস)।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, সাবমেরিন ক্যাবলে সরবরাহ সক্ষমতা ৭ দশমিক ২২ টিবিপিএসে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে। দেশের মোট চাহিদা মাত্র ৬ দশমিক ২ টিবিপিএস। এর মধ্যে বর্তমানে আইটিসি যোগান দেয় মাত্র ৩ দশমিক ৩ টিবিপিএস আর বিএসসিসিএল দেয় ২ দশমিক ৯ টিবিপিএস। অর্থাৎ প্রায় ৪ টিবিপিএসই অব্যবহৃত থেকে যায়।
ব্যান্ডউইথ আমদানি ব্যয়ে ব্যাপক ফারাক
আইটিসি ও সাবমেরিনের ব্যান্ডউইথ আমদানি খরচের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক ফারাক। বিএসসিসিএল ৭ দশমিক ২ টিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আমদানির জন্য বছরে খরচ করে প্রায় চার মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতনির্ভর ৪ দশমিক ৫ টিবিপিএসের জন্য আইটিসির খরচ পরে মোট প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার।
বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দিতে কৌশলে আইটিসির অপারেটরদের চেয়ে বিএসসিসিএলের ব্যান্ডউইথ সরবরাহের দাম বেশি রাখা হয়। এতে সেবাগ্রহীতা ও স্থানীয় খুচরা অপারেটররা ভারতনির্ভর আইটিসিগুলোকেই বেছে নিত। এ রকম নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পদ্ধতিগতভাবে ভারতের ব্যান্ডউইথ ব্যবসার জন্য অবারিত সুযোগ করে দেয়।
আরো যত অপকৌশল
আইটিসির মাধ্যমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে ভারতও পিছিয়ে থাকেনি। ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সীমান্তের কাছাকাছি অনেক ডাটা সেন্টার তৈরি করে। এ ডাটা সেন্টারগুলোর সার্ভারের মাধ্যমে কনটেন্ট প্রোভাইডারদের ক্যাশ সার্ভার হোস্ট করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ক্লাউডফেয়ার ইত্যাদি বড় মালটিন্যাশনাল সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপসগুলো। এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীরা আইটিসি হয়ে ভারতীয় ক্যাশ সার্ভার থেকে ব্যান্ডউইথের মাধ্যমে কনটেন্ট পেতে সাবমেরিন ক্যাবলের তুলনায় সময় লাগে কম।
সাবমেরিন ক্যাবলে কনটেন্টগুলো সিঙ্গাপুরের ক্যাশ সার্ভারের মাধ্যমে গ্রাহকরা পায়। দ্রুত কন্টেন্ট পাওয়ার সুবাদে গ্রাহকরাও আইটিসির মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি নির্ভরশীল ভাবতে শুরু করে। যদিও বাংলাদেশে কিছু অপারেটর এ ক্যাশ সার্ভার ইনস্টলেশন করে সাবমেরিনকে আইটিসির সঙ্গে ব্যালান্স করার চেষ্টা করেছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসি ২০২১ সালে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্যাশ সার্ভার ইনস্টলেশন অনেক সীমিত করে দেয়। তাতে আইটিসি কানেকশন আরো ব্যবসাসফল হয়ে ওঠে। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর বিটিআরসি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ সার্ভারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আপাত তুলে নেয়। একই সঙ্গে আইটিসির ব্যান্ডউইথ আমদানির চাহিদার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
আড়িপাতা ও ডাটা পাওয়ার সুযোগ ভারতের
ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানির ফলে আইটিসিনির্ভর ইন্টারনেট যোগাযোগে আড়িপাতার সুযোগ রয়েছে ভারতের। চাইলে যে কোনো সময় ইন্টারসেপ্ট বা আড়ি পাততে পারবে। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এ সুযোগ বাংলাদেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ভারত চাইলে জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো নজরদারি করতে পারবে আইটিসিনির্ভর যোগাযোগের কারণে। ফলে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও বিষয়টি হুমকিস্বরূপ।
শেখ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে তিনটি সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় মাইলফলক হতে যাচ্ছে এসএমডব্লিও-৬ কানেকশন। এর মাধ্যমে আরো ১৩ দশমিক ২ টিবিপিএস যোগ করে মোট ২০ দশমিক ৪২ টিবিপিএস সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যা দেশের ভেতরে উচ্চগতির ইন্টারনেট পাওয়া নিশ্চিত করবে। অথচ এখানেও আইটি খাতকে শেখ পরিবার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে দিতে হাসিনা সরকার আরো তিনটি প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর লাইসেন্স দিয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, সিডিনেট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও মেটাকোর সাবকম লিমিটেড।
এর মধ্যে প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর মেটাকোরের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজোয়ান, সিডিনেটের মালিকানায় চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং সামিটের মালিকানায় ফরিদ খান। মোহাম্মদ এ আরাফাত শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু। নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকেরও পরিচালক। সর্বশেষ একতরফা সংসদ নির্বাচনের পর মোহাম্মদ এ আরাফাতকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা এখনো কোম্পানিগুলোর মালিক হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পলিসি অ্যাডভাইজার ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আমার দেশকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোকে একক নির্ভরতা থেকে মুক্ত করা। এজন্য বিএসসিপিএলসির সক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবল পথের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ইন্টারনেট পয়েন্টে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিংগেল পয়েন্ট অব ফেইলিওর থেকে উত্তরণের জন্য বিটিআরসির পলিসি পরিবর্তন করা হতে পারে।
আইটিসিকে অতিমাত্রায় সুবিধা দেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরো বলেন, ‘এখন তা ঠিক করার প্রক্রিয়া চলছে। সাবমেরিন ক্যাবলের রেভিনিউ শেয়ারিং নিয়ে যে বৈষম্য ছিল, সেটা দূর করার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোকে ভারত নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে ইন্টারনেট বাজার প্রতিযোগিতামূলক ও সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায়।’
শেখ হাসিনার পতনের ছয় মাস পার হলেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো পুরোটাই ভারত ও ফ্যাসিবাদের দোসর শেখ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার সরকার নানা অপকৌশলে খাতটি শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও সরাসরি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়।
ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগের সব তথ্য ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে জমা হয়। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের সব ডাটা এখন রয়েছে ভারতীয় সার্ভারে। এতে জাতীয় নিরাপত্তাও হুমকির মুখে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনে তথ্যপ্রযুক্তি খাত ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি)। এজন্য বিটিআরসি সে সময় নানা অজুহাত তৈরি করে। সাবমেরিনের বিকল্প প্রয়োজনের কথা বলে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল (আইটিসি)। এর মাধ্যমে ভারতনির্ভর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবসার অনুমোদন দেওয়া হয়। পাশাপাশি তিনটি প্রাইভেট সাবমেরিনের অনুমোদনও দেয় হাসিনার সরকার। এগুলোর মালিকানা দেওয়া হয় সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক ও সামিট গ্রুপকে। কোম্পানি তিনটিকে ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয় ২০৪২ সাল পর্যন্ত। বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চুক্তি বাতিল না হলে তাদের হাতেই থাকবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ।
বাংলাদেশ ২০০৬ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল এসএমডব্লিও-৪-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। পরে সাবমেরিন ক্যাবলের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় সরকার ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) হিসেবে পরিচিত।
সূত্র বলছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবায় বিদ্যমান সাবমেরিন কোম্পানির যথেষ্ট সক্ষমতা ছিল। শুধু ভারতকে এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দিতে বিকল্প সরবরাহকারীর অজুহাত তোলা হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পরই বিকল্প ক্যাপাসিটি সরবরাহকারী তৈরি করার নামে ২০১২ সালে বিটিআরসি নতুন পাঁচটি প্রাইভেট অপারেটরকে লাইসেন্স দেয়। এগুলো ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবল অপারেটর (আইটিসি) হিসেবে পরিচিত। এগুলো সাবমেরিনের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে শুধু ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করে।
আইটিসির আওতায় রয়েছে ফাইবার@হোম, সামিট কমিউনিকেশনস, নভোকম, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স কমিউনিকেশন, বিডি লিংক কমিউনিকেশন এবং ম্যাংগো টেলিসার্ভিসেস। আইটিসি নিয়ন্ত্রিত সব প্রতিষ্ঠানই ভারতের বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানি থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করে।
বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইটি খাত ভারতের নিয়ন্ত্রণে দিতে আইটিসির মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্নভাবে বাড়তি সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন আইটিসির রেভিনিউ শেয়ার হচ্ছে এক শতাংশ। আর সাবমেরিন সংযুক্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডকে (বিএসসিসিএল) দিতে হয় তিন শতাংশ রাজস্ব। এ ছাড়া শুরুতে আইটিসির ব্যান্ডউইথ লিমিট দেওয়া হয় পুরো চাহিদার ৬০ শতাংশ। মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই বিটিআরসি এ নির্ধারিত সীমাও তুলে দেয়। এতে অবারিতভাবে আইটিসির আওতায় অনুমোদন পাওয়া ভারতনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যান্ডউইথ সরবরাহের ক্ষমতা লাভ করে।
এদিকে রাজস্ব শেয়ার তিন শতাংশ বহাল রেখেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডকেও (বিটিসিএল) আইটিসি লাইসেন্স দেওয়া হয়। মূলত ভারতকে আইটি খাত নিয়ন্ত্রণে দিতেই আইটিসির রাজস্ব শেয়ার এক শতাংশ করা হয়। সাব মেরিনের মতো বিএসসিসিএলের রেভিনিউ শেয়ার তিন শতাংশ বহাল রেখেই দুই বছর পর বিটিসিএলকেও আইটিসির লাইসেন্স দেওয়া হয়।
অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল এসএমডব্লিও-৫-এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এতে শুধু সাবমেরিন ক্যাবলে মোট ব্যবহারযোগ্য ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতা দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৮৫ টেরাবাইট পার সেকেন্ড (টিবিপিএস)।
বিটিআরসি সূত্র জানায়, সাবমেরিন ক্যাবলে সরবরাহ সক্ষমতা ৭ দশমিক ২২ টিবিপিএসে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে। দেশের মোট চাহিদা মাত্র ৬ দশমিক ২ টিবিপিএস। এর মধ্যে বর্তমানে আইটিসি যোগান দেয় মাত্র ৩ দশমিক ৩ টিবিপিএস আর বিএসসিসিএল দেয় ২ দশমিক ৯ টিবিপিএস। অর্থাৎ প্রায় ৪ টিবিপিএসই অব্যবহৃত থেকে যায়।
ব্যান্ডউইথ আমদানি ব্যয়ে ব্যাপক ফারাক
আইটিসি ও সাবমেরিনের ব্যান্ডউইথ আমদানি খরচের মধ্যেও রয়েছে ব্যাপক ফারাক। বিএসসিসিএল ৭ দশমিক ২ টিবিপিএস ব্যান্ডউইথ আমদানির জন্য বছরে খরচ করে প্রায় চার মিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতনির্ভর ৪ দশমিক ৫ টিবিপিএসের জন্য আইটিসির খরচ পরে মোট প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার।
বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে সুযোগ দিতে কৌশলে আইটিসির অপারেটরদের চেয়ে বিএসসিসিএলের ব্যান্ডউইথ সরবরাহের দাম বেশি রাখা হয়। এতে সেবাগ্রহীতা ও স্থানীয় খুচরা অপারেটররা ভারতনির্ভর আইটিসিগুলোকেই বেছে নিত। এ রকম নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে শেখ হাসিনা সরকার পদ্ধতিগতভাবে ভারতের ব্যান্ডউইথ ব্যবসার জন্য অবারিত সুযোগ করে দেয়।
আরো যত অপকৌশল
আইটিসির মাধ্যমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়ে ভারতও পিছিয়ে থাকেনি। ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সীমান্তের কাছাকাছি অনেক ডাটা সেন্টার তৈরি করে। এ ডাটা সেন্টারগুলোর সার্ভারের মাধ্যমে কনটেন্ট প্রোভাইডারদের ক্যাশ সার্ভার হোস্ট করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ক্লাউডফেয়ার ইত্যাদি বড় মালটিন্যাশনাল সামাজিক যোগাযোগ অ্যাপসগুলো। এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীরা আইটিসি হয়ে ভারতীয় ক্যাশ সার্ভার থেকে ব্যান্ডউইথের মাধ্যমে কনটেন্ট পেতে সাবমেরিন ক্যাবলের তুলনায় সময় লাগে কম।
সাবমেরিন ক্যাবলে কনটেন্টগুলো সিঙ্গাপুরের ক্যাশ সার্ভারের মাধ্যমে গ্রাহকরা পায়। দ্রুত কন্টেন্ট পাওয়ার সুবাদে গ্রাহকরাও আইটিসির মাধ্যমে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেশি নির্ভরশীল ভাবতে শুরু করে। যদিও বাংলাদেশে কিছু অপারেটর এ ক্যাশ সার্ভার ইনস্টলেশন করে সাবমেরিনকে আইটিসির সঙ্গে ব্যালান্স করার চেষ্টা করেছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিটিআরসি ২০২১ সালে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ক্যাশ সার্ভার ইনস্টলেশন অনেক সীমিত করে দেয়। তাতে আইটিসি কানেকশন আরো ব্যবসাসফল হয়ে ওঠে। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পালিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর বিটিআরসি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ সার্ভারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আপাত তুলে নেয়। একই সঙ্গে আইটিসির ব্যান্ডউইথ আমদানির চাহিদার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
আড়িপাতা ও ডাটা পাওয়ার সুযোগ ভারতের
ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানির ফলে আইটিসিনির্ভর ইন্টারনেট যোগাযোগে আড়িপাতার সুযোগ রয়েছে ভারতের। চাইলে যে কোনো সময় ইন্টারসেপ্ট বা আড়ি পাততে পারবে। আঞ্চলিক রাজনীতির কারণে এ সুযোগ বাংলাদেশের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ভারত চাইলে জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো নজরদারি করতে পারবে আইটিসিনির্ভর যোগাযোগের কারণে। ফলে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও বিষয়টি হুমকিস্বরূপ।
শেখ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে তিনটি সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর
বাংলাদেশের জন্য আরেকটি বড় মাইলফলক হতে যাচ্ছে এসএমডব্লিও-৬ কানেকশন। এর মাধ্যমে আরো ১৩ দশমিক ২ টিবিপিএস যোগ করে মোট ২০ দশমিক ৪২ টিবিপিএস সক্ষমতা অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যা দেশের ভেতরে উচ্চগতির ইন্টারনেট পাওয়া নিশ্চিত করবে। অথচ এখানেও আইটি খাতকে শেখ পরিবার ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে দিতে হাসিনা সরকার আরো তিনটি প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর লাইসেন্স দিয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ সামিট কমিউনিকেশনস লিমিটেড, সিডিনেট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও মেটাকোর সাবকম লিমিটেড।
এর মধ্যে প্রাইভেট সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর মেটাকোরের চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ছেলে রেজোয়ান, সিডিনেটের মালিকানায় চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও মোহাম্মদ এ আরাফাত এবং সামিটের মালিকানায় ফরিদ খান। মোহাম্মদ এ আরাফাত শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বন্ধু। নাফিজ সরাফাত পদ্মা ব্যাংকেরও পরিচালক। সর্বশেষ একতরফা সংসদ নির্বাচনের পর মোহাম্মদ এ আরাফাতকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা এখনো কোম্পানিগুলোর মালিক হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি গণহত্যার বিচার না হলে দেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে : রিজভীলালগালিচায় ঢাকার খালে নেমে খননের উদ্বোধন তিন উপদেষ্টারওমরায় যাওয়ার পথে বিমানে গুরুতর অসুস্থ বাবর, দুবাই হাসপাতালে ভর্তিমন্ত্রণালয়ের পলিসি অ্যাডভাইজার ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আমার দেশকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য দেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোকে একক নির্ভরতা থেকে মুক্ত করা। এজন্য বিএসসিপিএলসির সক্ষমতার কথা বিবেচনায় রেখে বিকল্প সাবমেরিন ক্যাবল পথের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ইন্টারনেট পয়েন্টে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিংগেল পয়েন্ট অব ফেইলিওর থেকে উত্তরণের জন্য বিটিআরসির পলিসি পরিবর্তন করা হতে পারে।
আইটিসিকে অতিমাত্রায় সুবিধা দেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব আরো বলেন, ‘এখন তা ঠিক করার প্রক্রিয়া চলছে। সাবমেরিন ক্যাবলের রেভিনিউ শেয়ারিং নিয়ে যে বৈষম্য ছিল, সেটা দূর করার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ইন্টারনেট অবকাঠামোকে ভারত নির্ভরতা থেকে মুক্ত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যাতে ইন্টারনেট বাজার প্রতিযোগিতামূলক ও সাশ্রয়ী হয়ে ওঠে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা যায়।’