জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। দলের প্রধান কে হবেন-সেটি মোটামুটি চূড়ান্ত। কিন্তু বাকি পদগুলোতে কারা আসবেন-সেটি নিয়ে নেতারা এখনো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেননি। নতুন দলের সংগঠকদের একটি সূত্র বলছে, মূলত মধ্যপন্থি, ইসলামপন্থি ও বাম-এই তিন ধারার নেতাদের মতপার্থক্যে আটকে আছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণার কার্যক্রম।
এর আগে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে দল ঘোষণার প্রস্তুতি নেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে এখন সংগঠন দুটি থেকে বলা হচ্ছে মাসের শেষদিকে আসতে পারে নতুন দলের ঘোষণা।
জাতীয় নাগরিক কমিটি সূত্র জানায়, নতুন দলের নেতৃত্ব ঠিক করতে সংগঠন দুটির শীর্ষ নেতারা কয়েকটি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রশিবির,ছাত্র পরিষদ ও বাম থেকে আসা ছাত্রনেতাদের মতভিন্নতায় আটকে আছে দল ঘোষণা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন দলের প্রধান হিসেবে বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন-এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এ পদ নিয়ে তেমন কোনো মতপার্থক্য নেই। তবে সদস্য সচিবসহ প্রথম সারির পদ নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। দ্বিতীয় শীর্ষ পদটিতে তিন পক্ষই তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে মরিয়া। এতে বেশি এগিয়ে আছেন ছাত্রশিবিরের রাজনীতি থেকে আসা ছাত্রনেতারা। এতে বাঁধ সাধছেন বাম ও মধ্যপন্থি ধারার ছাত্রনেতারা। তিন পক্ষের মতৈক্যে পৌঁছাতে আর কিছুটা সময় লাগবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় নাগরিক কমিটির এক যুগ্ম আহ্বায়ক আমার দেশকে বলেন, আন্দোলনের আগে-পরে শিবির থেকে যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন, তারা নতুন দলের নেতৃত্বে প্রভাব ধরে রাখতে চান। তাদের দাবি, নতুন দলের শীর্ষ পর্যায়ের পদ। কিন্তু এমন দাবি মানতে নারাজ জাতীয় নাগরিক কমিটি।
নাগরিক কমিটির ওই নেতা আরো জানান, শিবির থেকে আসা ছাত্রনেতাদের যুক্তি, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা বেশি ছিল। এখন তাদের জনবল বেশি। বাম ও নিরপেক্ষ ছাত্রনেতারা মনে করেন, শিবিরের রাজনীতি করা ছাত্র নেতাদের নতুন দলের নেতৃত্বে রাখলে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, সাধারণ মানুষ এমনিতেই ভাবছে জামায়াত-শিবির আমাদের নতুন দল গঠনে সহায়তা করছে।
অবশ্য নেতৃত্ব নিয়ে মতপার্থক্যের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি আমার দেশকে বলেন, নেতৃত্ব নিয়ে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা চলতি মাসের শেষ দিকে নতুন দল নিয়ে আত্মপ্রকাশ করব।
আখতার হোসেন আরো বলেন, নতুন দলের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কীÑ এ জন্য আমরা ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম। এখানে দেশের মানুষ তাদের মতামত দিয়েছে। এগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করেছি।
তবে নতুন দলের নেতৃত্ব নিয়ে সৃষ্টি হওয়া মতবিরোধের কথা স্বীকার করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে মতানৈক্য থাকায় নিজেদের মধ্য কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। একটি পক্ষ নিজেদের নেতৃত্ব ধরে রাখতে আরেক পক্ষকে ঘায়েল করার এক ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। এ রকম জটিলতার কারণে মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে বিরক্তিও আছে।
এই নেতার দাবি, সারা দেশে আওয়ামী লীগ আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে যেখানে আমাদের রাজনীতি করা উচিত বাইরে, সেখানে আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যেই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছি। তিনি আরো বলেন, জনগণ আমাদের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা করছে। তারা চায় আমরা একটা মধ্যপন্থার দল হব। সেখানে যদি শিবির থেকে আসা নেতাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসি, তাহলে আমাদের প্রতি মানুষ আস্থা হারাবে।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি আমার দেশ-এ ‘পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন আসিফ-নাহিদ’ এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছে, নতুন দল ঘোষণা করা হবে ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। আহ্বায়ক কমিটি হবে নতুন দলে। এতে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করে নতুন দলের সদস্য সচিব হবেন। এমন সংবাদে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
এরপর জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একাধিক নতুন নেতৃত্ব নিয়ে বৈঠক করে। বৈঠকগুলোতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নতুন দলে আহ্বায়ক হতে পারেন নাহিদ ইসলাম। তবে দল ঘোষণার আগে তিনি পদত্যাগ করবেন। নতুন দলে সদস্য সচিব হিসেবে আলোচনায় আছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এদিকে নতুন দলের গঠনতন্ত্র, দলের নাম ও সাধারণ মানুষের কাছে প্রত্যাশা জানতে সপ্তাহব্যাপী ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সংগঠন দুটি। কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ মানুষ তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে নতুন দলের নাম প্রস্তাব করেছেন শতাধিক মানুষ। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম হলো-রেভল্যুশনারি পিপলস পার্টি (আরপিপি), ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউডিপি), ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি), পিপলস রেভল্যুশন পার্টি (পিআরপি), ডেমোক্রেটিক পিপলস পার্টি (ডিপিপি), পিপলস মুভমেন্ট পার্টিসহ (পিএমপি) শতাধিক নামের তালিকা এসেছে। নামগুলো যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান নেতারা। নতুন দল ঘোষণার প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশের তিন শতাধিক থানা কমিটি করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয়ভাবে ৩০টির বেশি সমন্বয় সেল গঠন করেছে সংগঠনটি।