চট্টগ্রামে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ২০১৮ সালে ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয় চট্টগ্রাম ওয়াসা। কয়েক ধাপে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকায়। তবে সংশ্লিষ্টদের না জানিয়েই ২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। অর্থাৎ নিয়ম ভেঙে ১১১ শতাংশ ব্যয় বাড়িয়েছে সংস্থাটি। বিষয়টি নজরে এনেছে পরিকল্পনা কমিশন। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করেছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজের ডিজাইন পরিবর্তন, টেন্ডার আহ্বান এবং স্কোপ পরিবর্তন করে সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিজিপি) মাধ্যমে ক্রয় প্রস্তাব অনুমোদনের আগে প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন অথবা পরিকল্পনা কমিশনের পূর্বানুমোদন নেওয়া আবশ্যক। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন বলছে, বর্তমানে মোট ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পুনর্গঠন করে অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পুনরায় পাঠিয়েছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। পরিকল্পনা কমিশন জানেই না কীভাবে ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে।
পুনর্গঠিত ডিপিপি অনুযায়ী আলোচ্য সংশোধন প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন দেখেছে, মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে কাজের প্যাকেজ ডব্লিউ-১, ডব্লিউ-২ ও ডব্লিউ-৩ বাস্তবায়নের জন্য যথাক্রমে ৪১৭ কোটি ৭৮ লাখ, ১ হাজার ৪৪৪ কোটি ও ১৯১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। এ তিন প্যাকেজের পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদিত সর্বমোট ব্যয় ২ হাজার ৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকার সংস্থান ছিল। পরে ডিজাইন বিল্ড পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে ঠিকাদারের কাছ থেকে পাওয়া ডিজাইন ও দরের ভিত্তিতে সিসিজিপির অনুমোদনে ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা দর অনুযায়ী এ তিন প্যাকেজের সর্বমোট মূল্য দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৩৩৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এই প্রাক্কলন মূল ডিপিপির চেয়ে ২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা বা ১১১ শতাংশ বেশি।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্প সংশোধন বা পরিকল্পনা কমিশনের পূর্বানুমোদন না নিয়ে ডিজাইন পরিবর্তন ও বর্ধিত ব্যয়ে সিসিজিপির মাধ্যমে ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বরে প্যাকেজ ডব্লিউ-১ ও ২০২২ সালের ২২ জুন বাকি দুটি প্যাকেজের অনুমোদন করানো হয়।
তারা জানান, প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব অনুমোদন অথবা পরিকল্পনা কমিশনের পূর্বানুমোদন ছাড়া কীভাবে ডিজাইন পরিবর্তন, প্যাকেজগুলোর ক্রয় প্রস্তাব সিসিজিপির মাধ্যমে অনুমোদন ও কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা চেয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠিও দিয়েছেন তারা। এখনো চিঠির কোনো জবাব দেয়নি মন্ত্রণালয়।
চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রস্তাবিত ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থাপন (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটি মোট ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর একনেক সভায় অনুমোদিত হয়।
পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে প্রকল্পের প্রথম সংশোধন প্রস্তাব করা হয়। এর ভিত্তিতে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পিইসি সভা হয়। সভার সুপারিশ অনুযায়ী পুনর্গঠিত ডিপিপি একনেক অনুবিভাগে পাঠানো হয়। পরে গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপিত হলে স্থানীয় সরকার বিভাগ সেটি প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু এরপরও সেটি আবার মোট ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জুলাই ২০১৮ হতে জুন ২০২৬ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরডিপিপি পুনর্গঠনপূর্বক অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠালে কমিশন বিষয়টি নজরে আনে।
তবে প্রকল্প পরিচালক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাপারটি তা নয়। নতুন সরকার আসার পর কিছু প্রকল্প একনেক অনুবিভাগে যাওয়ার পরও সরকার আবার রিভিউ করছে। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি নিয়ে যা বলছে, তার সব সঠিক নয়। ওয়াসা চুক্তি করার আগে এর একটি প্রক্রিয়া আছে। পারসেজ কমিটিতে পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্যও থাকেন। ওয়াসার দায়িত্ব হলো চুক্তি করা।
আমার দেশকে তিনি বলেন, আমরা এখন শুধু ডলার সংশোধন করে প্রক্রিয়ার জন্য একনেকে পাঠিয়েছি। একনেকে যখন প্রকল্পটি পাঠানো হয়, তখন ডলারের রেট কম ধরা হয়েছিল। আমরা এখন হালনাগাদের জন্য পাঠিয়েছি। আমরা ধরেছিলাম ৯৫ টাকা। যখন একনেকে উঠেছিল, তখন ১১০ টাকা হয়ে গেছে। এখানে পরিকল্পনা কমিশনের ওই কথা (গোপন চুক্তির) বলার কোনো সুযোগ নেই।
মূলত বিগত সরকারের আমলে পরিকল্পনা কমিশনকে দুর্বল করে রাখা হয়। ক্রয় কমিটিতে পরিকল্পনা কমিশনের একজন সদস্য থাকলেও তিনি তার পর্যাপ্ত ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি। মূলত সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীদের কথায় প্রকল্পগুলো অনুমোদন করতে বাধ্য হতো কমিশন। তবে ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এ ধরনের বহু প্রকল্প রিভিউর জন্য মন্ত্রণালয়গুলোতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে মৌলভীবাজারে লাঠিটিলায় বন কেটে সাফারি পার্ক প্রকল্পটিও বাদ দেওয়া হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, প্রকল্পটিতে মূলত বিদেশি একটি কোম্পানির স্বার্থ রয়েছে। এ প্যাকেজগুলোর একটি হলো ওয়াসার বর্জ্য পুড়িয়ে সার বানানো। বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের এই সময়ে এটি সম্ভব নয়। তাছাড়া আরেকটি প্যাকেজে মাটির গভীরে পাইপলাইন চালু করা। সেটি একবার বন্ধ হলে ঠিক করার আর কোনো উপায় নেই। তাছাড়া পরিকল্পনা কমিশনকে না জানিয়ে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া বিধির লঙ্ঘন। সে জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা লিখিত প্রশ্নের জবাবে জানান, অনুমোদিত ডিপিপির অনুশাসন অনুযায়ী ডিজাইন চূড়ান্ত করে সিসিজিপির অনুমোদনক্রমে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
অনুমোদনবিহীন প্যাকেজগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, অনুমোদিত ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী ৩টি প্যাকেজে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। একটি প্যাকেজে পয়োশোধনাগার, ফিকেল স্লাজ শোধনাগার ও পয়ো পাইপলাইন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত আছে এবং অপর দুটি প্যাকেজে পয়ো পাইপলাইন নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত আছে।
ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, গ্রহণযোগ্য ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকল্প কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে পরিবেশগত ঝুঁকি নেই বরং পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে স্বাস্থ্যসম্মত নগরী গড়ার লক্ষ্যে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, একটি প্যাকেজে গভীরভাবে পাইপলাইন টানার প্রস্তাব আছে, যা একবার নষ্ট হলে আর মেরামতের সম্ভাবনা নেই। ঝুঁকি আছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূল ডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী গভীর পয়ো পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এ ধরনের পাইপলাইন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি নেই বললেই চলে এবং কোনো কারণে নষ্ট হলেও এটি মেরামতযোগ্য।