আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে সীমাহীন লুটপাট হয়েছে। লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে এ খাত। এ খাত ধ্বংসের কারিগর ছিলেন সাবেক তিন গভর্নর- আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। জুলাই বিপ্লবে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনা পালানোর পর দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ইউনূস সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংক খাতের সংস্কার সাধন। যদিও এ খাত যারা ধ্বংস করেছেন, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। তাদের ধরার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম গ্রেপ্তারের পর জনমনে প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক খাত ধ্বংসের কারিগররা গ্রেপ্তার হবেন কবে।
শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে চলে যান ড. আতিউর রহমান। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তার পাসপোর্ট ব্লক করেছে সরকার। ফজলে কবির দেশেই রয়েছেন, তবে শেখ হাসিনার পতনের পর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুর রউফ তালুকদার।
তিনি দেশে নাকি বিদেশ আছেন, তার কোনো খবর মেলেনি। ব্যাংক খাত থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করার সুযোগ করে দেন তারা। সরকার যদি তাদের সহযোগিতার দায়ে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরো অনেকে এসব করার সুযোগ পাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী এ নিয়ে বলেন, ‘বিগত সময়ে একটা চক্র গড়ে উঠেছিল। যার পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে তৎকালীন সরকার। এ চক্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ছিলেন। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, জেলে যেতে হচ্ছে। যারা অনিয়মে যুক্ত ছিলেন, তাদের সবার বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নইলে বিচার পরিপূর্ণ হবে না। এতে অন্যরা আবার একই পথে হাঁটবে।’
তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ১৫ বছরে সরকারি ব্যাংকে যেমন লুটপাট হয়েছে, তেমনি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ ছাড় নীতিতে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ও তদারকির দুর্বলতায় বড় বড় ঋণ জালিয়াতিসহ অসংখ্য লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ছয় লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল হয়েছে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়। এ সুযোগে বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা হয়।
হলমার্কের জালিয়াতি দিয়ে আতিউরের শুরু : আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা নেওয়ার দিন গভর্নর ছিলেন বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। ২০০৯ সালের ১ মে গভর্নর পদে নিয়োগ পান আতিউর রহমান।
তার মেয়াদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকিতে ছিল দুর্বলতা। এ সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া হয়। এর আগে এত বড় ঋণ জালিয়াতির নজির ছিল না। এ জালিয়াতির জেরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরামর্শে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আনে সরকার। তার সময়ই আবার বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করেও তা রুখতে পারেনি।
এ ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে দুই হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। আবার ২০১২ সালে নতুন ব্যাংক অনুমোদনের উদ্যোগ নেওয়া হলে কারা তা পাবেন, সে তালিকা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গভর্নরকে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতাদের ৯টি ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন সুবিধা পায় বেক্সিমকো, এমআর গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা, থার্মেক্স, শিকদার, আবদুল মোনেম ও এননটেক্স গ্রুপ। এসব ঋণের অধিকাংশই এখন খেলাপির খাতায়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় প্রশ্ন ওঠে। তবে তার সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। রিজার্ভ চুরির ধামাচাপা দেওয়ার ‘মাস্টারমাইন্ড’ছিলেন আতিউর। এ ঘটনার পরই তিনি পদত্যাগ করেন।
এস আলমের হাতে ব্যাংক তুলে দিয়ে কবিরের শুরু :
২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরি হলে আতিউর রহমান পদত্যাগ করলে ওই বছরের ২০ মার্চ সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির গভর্নর পদে নিয়োগ পান। ২০১৭ সালের শুরুতে বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক ও পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দখল করে এস আলম গ্রুপ।
গভীর রাতে ও বাসায় বসে এই দখল অনুমোদন দেন ফজলে কবির। এরপর এসব ব্যাংকে লুটপাট শুরু হলে তিনি তদারকি কমিয়ে দেন। গভর্নরের অফিস ও বাসভবনে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তাদের অবাধ যাতায়াত শুরু হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও কোনো বিভাগে কারা দায়িত্বে থাকবেন, তাতেও হস্তক্ষেপ শুরু করে গ্রুপটি। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারাও বিভিন্ন পদের জন্য এস আলম গ্রুপ নির্ভর হয়ে পড়ে।
এছাড়া ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করার কৌশলও তার আমলে নেওয়া হয়। সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রাখা ও নামমাত্র টাকা দিয়ে খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার পদ্ধতি চালু করে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়া হয়। এতে পুরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে ব্যাংক খাত। আবার তার আমলে বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে ব্যবসায়ীদের চাপে ফজলে কবিরকে গভর্নর পদে রাখতে আইনে পরিবর্তন আনে সরকার।
খেলাপিদের ছাড় ও এস আলমের ব্যাংকে সুবিধা দিয়ে তালুকদারের শুরু :
২০২২ সালের জুলাইয়ে আরেক সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে দায়িত্ব নেন। তার আমলেও আগের মতো বেনামে ঋণ ও জালিয়াতি করে ঋণ বিতরণের ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। পরে অনিয়মে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে পড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তিনি এসেই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। নতুন নীতিমালায় আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। আগে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেওয়া হতো।
আবার তার সময়ে এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব টাকাও ঋণের নামে তুলে নেয় এস আলম গ্রুপ। আবার রিজার্ভ থেকেও ডলার দেওয়া হয় তৎকালীন সরকারের কাছের ব্যবসায়ীদের। তার সময়ে আর্থিক তথ্য প্রকাশ সীমিত করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশও বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পতন ঘটলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে পদত্যাগ করেন। তার ফোন বন্ধ রয়েছে। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
ব্যাংক খাত ধ্বংসে তিন গভর্নর ছাড়াও ডেপুটি গভর্নর, বিএফআইইউ ও অন্যান্য শীর্ষপদে ছিলেন, তাদের অনেকেই অনিয়মে সহযোগিতা করার পাশাপাশি সুবিধাভোগী ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছেনÑ সাবেক ডিজি সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরকে চৌধুরী ও বিএফআইইউ সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। তারা বর্তমানে দুদকের মামলায় জেলহাজতে আছেন।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর মধ্যে সাবেক ডিজি এস এম মনিরুজ্জামান, তিনি উদ্যোগ নিয়ে ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন বন্ধ করে দেন। বিএফআইইউ সাবেক হেড রাজী হাসান, যার সময়ে অর্থপাচার হলেও প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
এ ছাড়া ডিজি কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মো. নাছেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ আছে ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কাজী ছাইদুর রহমান ও ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।