ভারতীয় আদানি পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি শুল্ক ফাঁকির এ ঘটনা উদঘাটন করে।
বিদ্যুৎ আমদানিতে চুক্তিকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুল্ক ফাঁকির এ দায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ওপর বর্তায় বলে মনে করছে তদন্ত কমিটি।
বিপুল পরিমাণ শুল্ক আদায়ে এনবিআরের আওতাধীন তিনটি বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। বিভাগ তিনটি হলো- রাজশাহী কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, বৃহৎ করদাতা ইউনিট (মূসক) ও ঢাকা কাস্টমস হাউস। এদিকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক পরিশোধের দায় বিপিডিবির বলে স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানি পাওয়ার প্লান্ট থেকে মোট ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি হয়। অগ্রিম আয়কর ব্যতীত আমদানি করা এ পরিমাণ বিদ্যুতের মূল্য বাবদ ১২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ডলারেরও বেশি পরিশোধ করেছে পিডিবি। পরিশোধিত মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ও ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর হিসাবে পরিশোধিত মূল্যের ওপর মোট ৩১ শতাংশ শুল্ক ধার্য ছিল।
এ হিসাবে সরকারের কোষাগারে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ডলার বা ৪ হাজার ৭৬৮ কোটি ৪৫ হাজার টাকা জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পিডিবি কোনো টাকাই জমা দেয়নি। মূলত ভারত থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে যে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয় সেখানে শুল্ক মওকুফের কথা থাকলেও এনবিআরের পক্ষ থেকে শুল্ক ছাড়ের বিষয়ে কোনো ধরনের আদেশ জারি করা হয়নি।
ফলে আদানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবির কাছ থেকে শুল্ক হিসাবে ৫ হাজার কোটি টাকা আদায়যোগ্য বলে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে মত প্রকাশ করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের মহাপরিচালক এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমার দেশকে বলেন, এ বিষয়টি আমরা অবহিত হয়েছি। চুক্তি অনুযায়ী শুল্ক ফাঁকির যে দায় সেটা বিপিডিবিকে বহন করতে হবে। পিডিবি এ বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে জানাবে। বিদ্যুৎ বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়কে শুল্ক পরিশোধের জন্য অনুরোধ জানাবে।
এখন অর্থ মন্ত্রণালয় এনবিআরকে শুল্ক পরিশোধ করতে পারে কিংবা শুল্ক মওকুফে এনবিআরকে প্রজ্ঞাপন কিংবা আদেশ জারির নির্দেশ দিতে পারে। তিনি আরো বলেন, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতির জন্য আমরা এনবিআরকে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু এনবিআর আমাদের অনুরোধ রাখেনি।
এদিকে শুল্ক আদায়ে তদন্ত কমিটি যে তিনটি ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। তবে এখনো এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব পাননি বলে জানিয়েছেন এলটিইউর একজন কর্মকর্তা।
তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আমরা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কিংবা কমিটির সুপারিশের বিষয়ে এখনো কিছু জানি না। এনবিআরের পক্ষ থেকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব। বৃহৎ করদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিডিবি এলটিইউর আওতাধীন বলেও জানান তিনি।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আদানি পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে চিঠি দেওয়া হয়।
এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম নামে ভারতীয় অপর একটি কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে- এমন উদাহরণ তুলে ধরে আদানিও তাদের জন্য একই সুবিধা বহালের আবেদন জানায়। কিন্তু এনবিআরের পক্ষ থেকে আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক ছাড়ের কোনো আদেশ জারি হয়নি।
অবশ্য পিডিবির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিকে বলা হয়েছে, এনবিআরের শুল্ক প্রকল্প সুবিধা, কাস্টমস আইন-১৯৬৯, মূসক আইন-১৯৯১-এর সংশ্লিষ্ট ধারার ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকারের সঙ্গে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত সমঝোতার আলোকে পিডিবির আমদানি করা বিদ্যুতের ওপর প্রযোজ্য সব ধরনের শুল্ক-কর মওকুফ করা হয়েছে। সম্পাদিত চুক্তি ও এনবিআরের নির্দেশনার আলোকে বিদ্যুৎ আমদানি কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে মর্মে পিডিবি তাদের জবাবে উল্লেখ করেছে।
তবে পিডিবির এই বক্তব্য মানতে নারাজ শুল্ক ও কাস্টমস গঠিত তদন্ত কমিটি। তাদের বক্তব্য, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ আমদানিতে সমঝোতা চুক্তি স্মারকে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আদান-প্রদান বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এটি সুনির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির নিকট থেকে আমদানির বিষয় নয় এবং শুল্ক অব্যাহতির বিষয়ে কোনো বক্তব্য উপস্থাপিত হয়নি।
তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, আদানির সঙ্গে পিডিবির স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বিদ্যুৎ আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতির কথা উল্লেখ রয়েছে। শুল্ক ছাড় বা অব্যাহতির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের (এনবিআর) কাছ থেকে আদেশ বা প্রজ্ঞাপন অনুমোদনের দায়িত্ব পিডিবির।
চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে শুল্ক-করাদির বিষয়ে কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হলে পিডিবি তা পরিশোধ করবে। যেহেতু আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতি দেওয়া হয়নি সেক্ষেত্রে পিডিবিকে পরিশোধিত মূল্যের ওপর ধার্য করা শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
অন্যদিকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে কাস্টমস আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে বলেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য আমদানির আগে পণ্যের বিস্তারিত উল্লেখ করে কাস্টমস হাউজ বা শুল্ক স্টেশনে একটি নির্দিষ্ট ফর্মে উল্লেখ করতে হয় যা বিল অব এন্ট্রি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পিডিবির পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো কিছুই করা হয়নি। ফলে কাস্টমস আইন লঙ্ঘন করে পিডিবি বিদ্যুৎ আমদানি করেছে বলে তদন্ত কমিটি মত প্রকাশ করেছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ থেকে পিডিবি রাজশাহীর রহনপুর শুল্ক স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ এবং সঞ্চালন করা হচ্ছে। তা বাংলাদেশ কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ বা কাস্টমস আইন-২০২৩ অনুযায়ী শুল্ক স্টেশন নয়।
উক্ত সীমান্ত দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি কেন্দ্রীয় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এসাইকোডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম যাচাই করে দেখা যায়, বিদ্যুৎ নামে পণ্য আমদানির কোনো বিল অব এন্ট্রি এখনো দাখিল হয়নি। এমনকি রহনপুর শুল্ক স্টেশনের আমদানিযোগ্য পণ্য তালিকায় বিদ্যুৎ নামে কোনো পণ্য অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে বিদ্যুৎ আমদানির বিল অব এন্ট্রি দাখিলের বিষয়টি আইনানুগ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি সই করে। নিয়ম অনুযায়ী, সরকার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চুক্তি বা প্রটোকল স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর মতামত নিয়ে থাকে।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরের মতামত ছাড়াই কঠোর গোপনীয়তা অনুসরণ করে ওই চুক্তি সই করা হয়। তবে ২০২২ সালের শেষের দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি। বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে ওই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিও তোলা হয়। এরই মধ্যে আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাতিলে গত নভেম্বরে উচ্চ আদালতে একজন আইনজীবী রিট দাখিল করেছেন। রিটের শুনানি নিয়ে আদানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি পুনর্মূল্যায়নে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে এক মাসের মধ্যে কমিটি এবং পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আদানির কাছ থেকে পুরো এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আসন্ন গ্রীষ্মকালের চাহিদা বিবেচনায় এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।