প্রশাসনে বিগত হাসিনা সরকারের দুঃশাসন, অনিয়ম, অর্থ লোপাট ও ভোট কারচুপির সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যেই বেশকিছু কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত (ওএসডি) করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনে থাকা হাসিনা সরকারের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ও আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও প্রশাসনকে গতিশীল করাসহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে অসহযোগিতা করছেনÑ এমন কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক টিমসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে আমার দেশকে নিশ্চিত করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। হঠাৎ করে সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে প্রশাসনের ভেতরে থেকে বিভিন্ন ব্যানারে পরিচালিত কর্মকর্তাদের কর্মসূচিগুলোও বাতিল ও স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশাসনকে গতিশীল করে কাঙ্ক্ষিত জনসেবা নিশ্চিত করতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা চালু রাখবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় দুটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি প্রশাসনে থাকা পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের সহযোগীদের চিহ্নিত করতে কাজ করছে। তিনজন উপদেষ্টা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অফিস শেষে সচিবালয়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। পাশাপাশি ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচন, ২০১৮ সালের রাতের ভোট ও ২০২৪ সালের ডামি ভোটের নির্বাচনের কারিগর হিসেবে চিহ্নিত কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মুখলেস উর রহমান।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাতের ভোট হিসেবে কুখ্যাতি পাওয়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ৬৪ জেলার ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ৪৯৪ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের অধিকাংশকেই পদোন্নতি নিয়ে বিগত সরকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পদায়ন করে। এরা বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত। আর্থিক অনিয়মসহ নানা ধরনের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সরকার তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিলের নির্দেশনা দেওয়ার পর থেকে তারা সরকারের কাজে অসহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব কর্মকর্তার বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলও (বিএনপি) এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাবেক সিনিয়র সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহর প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সিভিল প্রশাসন তার স্বকীয়তা হারিয়ে একটি দলীয় প্রশাসনে রূপ নিয়েছিল। ওই সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিনা ভোট, নৈশভোট ও ডামি ভোটের অবৈধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, গুম, খুন, মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তা হরণের সঙ্গে সিভিল প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত ছিলেন।
ওই আমলে দেশ থেকে দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। দেশকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে ‘চোরতন্ত্রে’ পরিণত করা হয়েছে। এই ‘চোরতন্ত্রে’ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ, ব্যবসায়িক অলিগার্ক ও আমলারা সহযোগী ছিল।
ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার পরও অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ছয় মাসের মেয়াদকালে তেমন উদ্যোগ নেয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের ভোটের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এমন ৪৩ কর্মকর্তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় মাঠপ্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র। দুদিনের মাথায় চার সচিবসহ ২২ অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনার ভুয়া নির্বাচনের অংশীদার হওয়ায় এ পর্যন্ত ৭৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটি চলমান থাকবে বলেও জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মুখলেস উর রহমান।
রাতের ভোটসহ শেখ হাসিনার আমলের তিনটি ভুয়া নির্বাচনের মূল কারিগর ছিলেন সাবেক কয়েকজন আইজিপিসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের অত্যাচার এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এমন কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ও আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক তদন্তের পর ফৌজদারি মামলা, গ্রেপ্তার, অব্যাহতি দেওয়াসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে চার শতাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। পুলিশ বাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তা।
ভুয়া ভোট ও রাতের নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তাদের অবসরে পাঠানোর বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘বিতর্কিত নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন এবং যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম তাদের ওএসডি করা হচ্ছে। এ ছাড়া ২৫ বছরের বেশি চাকরি করেছেন যেসব কর্মকর্তা তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হচ্ছে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে।
ড. মুখলেস আরো বলেন, বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে কেউ বলে ভুয়া ভোট, কেউ বলে রাতের ভোট আবার কেউ বলে অগ্রহণযোগ্য ভোট। আমরা যে নামেই ডাকি ওই নির্বাচনগুলো আসলে কোনো নির্বাচনই ছিল না। এগুলো ছিল প্রহসনের নির্বাচন ও জাতির সঙ্গে তামাশা মাত্র। ওই সময়ের সরকার এদের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনগুলো করেছিল। এমন আরো যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান সিনিয়র সচিব ড. মুখলেস।
প্রশাসনের কাঁধে ভর করে শেখ হাসিনা তার ফ্যাসিবাদী শাসনকে স্থায়ী রূপ দিতে পেরেছিলেন উল্লেখ করে ড. মুখলেছুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনার রেজিমে প্রশাসনে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার মূল্যায়ন ছিল না। দলীয়করণ করতে গিয়ে গোটা প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। জনপ্রশাসনকে পুরোপুরি আওয়ামী প্রশাসনে পরিণত করা হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, গত তিনটি ভুয়া ভোটের কারিগর, ফ্যাসিস্ট সরকারের সহকারী ও গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে ভূমিকা রেখেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করছে।