সাত মাস পার হয়েছে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়েছে। এতদিন পরও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিটিআরসি এখনো রয়েছে আওয়ামীপন্থিদের কব্জায়। দলীয় পরিচয়ে অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শতাধিক কর্মকর্তা একে কুক্ষিগত করে রেখেছে। তারা এখনো ফ্যাসিস্ট সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছেন বলেই প্রকৃত সেবা পাচ্ছেন না দেশের জনগণ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, বিটিআরসিতে নিয়োগ পাওয়াদের বেশির ভাগের প্রক্রিয়াই ছিল অবৈধ। নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে দলীয় পরিচয় ও আওয়ামী মন্ত্রী-এমপিদের সুপারিশকে প্রাধান্য দিয়েই এসব নিয়োগ দেওয়া হয়। একে গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগের মিনি কার্যালয় হিসাবে।
অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব আওয়ামী দলীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অডিট রিপোর্ট দেয় টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তি (পিটিএসটি) অডিট অধিদপ্তর। যুগান্তরের হাতে আসা এ রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অবৈধ নিয়োগধারীরা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো শুধু জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়ে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ পরিচয়ে এখানে সহকারী পরিচালক ও অন্যান্য পদে নিয়োগ পেয়েছেন যা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এমনকি তাদের অনেকেরই নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা।
বিটিআরসির প্রশাসন বিভাগের পরিচালক এমএ তালেব হোসেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের আপন ভাতিজা। সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেসের উপপরিচালক থেকে এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন বিভাগে পরিচালক পদে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পদোন্নতি বাগিয়েছেন। সরকারের অডিট অধিদপ্তর, এ অনিয়ম বাতিল করে অতিরিক্ত বেতন-ভাতা ফেরতের সুপারিশ করলেও বাস্তবে তা উপেক্ষিত হয়েছে।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সুপারিশে প্রশাসন বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পান তৌহিদুন নাহার, তিনি বর্তমানে উপপরিচালক। শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সুপারিশে স্পেকট্রাম বিভাগে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পায় সামিরা তাবাসসুম। বর্তমানে তিনি অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে শিক্ষা ছুটিতে রয়েছেন। মামাশ্বশুর আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের সুপারিশে নিয়োগ পান প্রশাসন বিভাগে কর্মরত উপপরিচালক মো. মিরাজুল ইসলাম। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সুপারিশে সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান মাহরীন আহসান, যিনি বর্তমানে স্পেকট্রাম বিভাগের উপপরিচালক। সুধা সদনের বিশেষ অনুরোধে এসএম গোলাম সারওয়ার লিগ্যাল অ্যান্ড লাইসেন্সিং বিভাগে যোগ দেন এবং বর্তমানে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের উপপরিচালক খালেদ ফয়সাল রহমানের নিয়োগ ছিল পুরোটাই অনিয়মে। অভিযোগ রয়েছে, বয়স সংশোধন করে এবং কোনো লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই তিনি চাকরি পেয়েছেন। বাবা মফিজুর রহমান বাবলু ছিলেন কুমিল্লা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি। তার রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতা অপব্যবহারই ছিল এ নিয়োগের মূল চালিকাশক্তি।
শেখ হাসিনার এক সময়ের প্রটোকল অফিসার ও দ্বাদশ সংসদের এমপি আলাউদ্দিন নাসিমের শ্যালিকা শারমিন সুলতানা বর্তমানে স্পেক্ট্রাম বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে কর্মরত। লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই চাকরিতে যোগ দেওয়া, চাকরির বয়স পরিমার্জন এবং স্নাতকোত্তরের সনদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি; এসব অনিয়ম নিরীক্ষা ও মন্ত্রণালয়ের তদন্তে প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
হাসিনার ফুপাতো ভাই ফজলে নূর তাপসের সুপারিশে নিয়োগ পান সনজীব কুমার সিংহ, যিনি বর্তমানে অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগে উপপরিচালক হিসাবে কর্মরত। নিরীক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়োগের শর্ত উপেক্ষা করে শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পান এবং পরে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু আওয়ামী পরিবারের সন্তান হওয়ায় প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড ইন্সপেকশন বিভাগের উপপরিচালক নাফিসা মল্লিক। সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) পদে যোগ দিলেও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রির কোনো সনদ জমা দেননি। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, কারিগরি পদে তার যোগ্যতা নেই, ফলে নিয়োগ অবৈধ। তবুও কমিশন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ২৪৫তম সভায় তাকে উপপরিচালক হিসাবে পদোন্নতি দিয়েছে।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদারের কাছের লোক ইন্সপেকশন এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের পরিচালক মো. নুরুন্নবি। যিনি নিয়োগ বিধি ও বিটিআরসি কর্মচারী চাকরি প্রবিধানমালা উপেক্ষা করে সিনিয়র সহকারী পরিচালক পদে লিখিত ও মোখিক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়েছেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাদের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন উপপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক। যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে সারা দেশে ১০ হাজার লোক মাঠে নামানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ কাজে তাকে মদদ দেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেসের উপপরিচালক এসএম তাইফুর রহমান, প্রশাসন বিভাগের উপপরিচালক এসএম আফজাল রেজা, সহকারী পরিচালক শারমিন কিবরিয়া, কাজী রাফসান ইয়াজদানি, কাজী মাহমুদুর রহমানসহ আরও অনেকে।
বিটিআরসির একাধিক সূত্র জানায়, এ কর্মকর্তারা মিলে একটি গোপন সিন্ডিকেট গঠন করেন, যারা টেলিকম অপারেটরদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিপুল অর্থ আদায় করতেন। বিরোধী ব্যবসায়ীদের বিপদে ফেলতে ‘ম্যানিপুলেটিভ’ রিপোর্ট তৈরি করা হতো এবং পরবর্তী সময়ে মোটা অঙ্কের লেনদেনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা হতো।
সূত্র বলছে, শতাধিক অবৈধ নিয়োগধারী সংঘবদ্ধভাবে যখন যে চেয়ারম্যান আসে তার নেতৃত্বাধীন কমিশনকে জিম্মি করে ফেলে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেয় না। অডিট অধিদপ্তরের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এর ফলে অবৈধ নিয়োগধারীরা বিটিআরসিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে সক্ষম হচ্ছে।
ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়ব যুগান্তরকে জানান, বিটিআরসির অনিয়ম তদন্তে একটি স্বাধীন কমিটি গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট, লিগ্যাল এক্সপার্ট ও ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্টরা থাকবেন। তিনি বিটিআরসিকে আহ্বান জানান, অডিট আপত্তির তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের পদোন্নতি আপাতত স্থগিত রাখতে। কমিটির মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এছাড়া আওয়ামী দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে যারা চাকরি ও পদোন্নতি পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিটিআরসি যদি ব্যবস্থা না নেয়, সরকার অবশ্যই পদক্ষেপ নেবে বলে তিনি জানান।