আমাদের দেশে বেশিরভাগ মেয়েরা কম বয়সে গর্ভধারণ করে এবং প্রায় সবাই অপুষ্টির শিকার হয়। এর ফলে অপুষ্ট সন্তান জন্মগ্রহণ করে বা কখনো কখনো মহিলারা মৃত সন্তানও প্রসব করে। তাই গর্ভাবস্থায় মাকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি পরিমাণ খাবার খেতে হবে।
▶ গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন তিন বেলা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি খাবার খেতে হবে।
▶ মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, কলিজা, ঘন ডাল, গাঢ় সবুজ শাক-সবজি ও মৌসুমি দেশী ফল খেতে হবে। রান্নায় স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি তেল ব্যবহার করতে হবে।
▶ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন রাতের খাবারের পরপরই ১টি করে আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট খেতে হবে।
▶ ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার খেতে হবে।
▶ গর্ভাবস্থায় তিনমাসের পর প্রতিদিন (সকালে এবং দুপুরে) দুইটি করে ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরা পেটে খেতে হবে।
▶ এ সময় যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম (দুপুরে খাবারের পর ২ ঘণ্টা এবং রাতে ৮ ঘণ্টা) নিতে হবে।
▶ গর্ভবতী মহিলাকে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিতে রাখতে হবে, এতে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হবে।
▶ ভারী কাজ (যেমন- টিউবওয়েল চাপা, ধান ভানা, ভারী জিনিস তোলা, অতিরিক্ত/ভারী কাপড় ধোয়া) থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কষ্টকর পরিশ্রম বর্জন করতে হবে।
▶ আয়োডিন যুক্ত লবণ খেতে হবে।
▶ প্রথম তিনমাসের পর প্রয়োজনে একটি কৃমিনাশক ট্যাবলেট খেতে হবে।
▶ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
* গর্ভকালীন যত্ন
গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার গর্ভকালীন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে (মায়ের ওজন, রক্তস্বল্পতা, রক্তচাপ, গর্ভে শিশুর অবস্থান পরীক্ষা করা)।
▶ ১ম স্বাস্থ্য পরীক্ষা ১৬ সপ্তাহে (৪ মাস)।
▶ ২য় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ২৪-২৮ সপ্তাহে (৬-৭ মাস)।
▶ ৩য় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ৩২ সপ্তাহে (৮ মাস)।
▶ ৪র্থ স্বাস্থ্য পরীক্ষা ৩৬ সপ্তাহে (৯ মাস)।
* রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা
যদি আপনি কোনো টিটি টিকা না দিয়ে থাকেন তবে টিকা শুরু করতে হবে এবং গর্ভাবস্থায় ৫ মাস পর ২টি টিটি টিকা নিতে হবে, সিডিউল অনুযায়ী বাকি টিকাগুলো নিতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী ইমিউনিটির জন্য ৫টি টিটি টিকার নির্ধারিত সময়সূচি-
▶ ১ম ডোজ : ১৫ বছর বয়সে অথবা প্রসব পূর্ববর্তী প্রথম ভিজিটে।
▶ ২য় ডোজ : ১ম ডোজ নেওয়ার অন্তত এক মাস পর।
▶ ৩য় ডোজ : ২য় ডোজ নেওয়ার অন্তত ছয় মাস পর।
▶ ৪র্থ ডোজ : ৩য় ডোজ নেওয়ার কমপক্ষে এক বছর পর।
▶ ৫ম ডোজ : ৪র্থ ডোজ নেওয়ার কমপক্ষে এক বছর পর।
* গর্ভাবস্থায় ওজন বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ
শিশু ও কিশোরী বয়সে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টিতে এবং রক্তস্বল্পতায় ভোগা, কিশোরী বা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করা, ঘন ঘন সন্তান ধারণ করা, গর্ভাবস্থায় কম খাদ্য গ্রহণ ও সুষম খাদ্য গ্রহণ না করা, গর্ভকালীন সময়ে রক্তস্বল্পতায় ভোগা, বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ও কৃমিতে আক্রান্ত হওয়া, শারীরিক পরিশ্রম বেশি করা ও মানসিক উদ্বেগ থাকা এবং খাদ্য সংক্রান্ত কুসংস্কার ও পরিবারে অসম খাদ্য বণ্টন।
* প্রসূতিকালীন পরিচর্যা ও প্রসূতি মায়ের পুষ্টি
প্রসবোত্তর সেবা নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। প্রসবের পর থেকে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কে ‘প্রসবোত্তর কাল’ বলা হয়। এ সময় মায়ের বিশেষ সেবা প্রয়োজন। কারণ এ সময় শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য মায়ের শরীরের ক্ষয় হয়। শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান মায়ের দুধে বিদ্যমান; যা শিশু মায়ের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। এজন্য এ অবস্থায় মায়ের শরীর সুস্থ রাখার জন্য সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার এবং বাড়তি যত্নের প্রয়োজন।
* প্রসব পরবর্তী যত্ন
প্রত্যেকবার খাবারের সময় প্রসূতি মাকে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি পরিমাণে খাবার খেতে হবে। অতিরিক্ত খাবার শিশুর জন্য মায়ের দুধ তৈরি করতে সহায়তা করে এবং মায়ের নিজের শরীরের ঘাটতি পূরণ করে।
▶ দুগ্ধদানকারী মাকে সব ধরনের পুষ্টি সমৃদ্ধ (আয়রন, ভিটামিন-এ, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি) খাবার খেতে হবে।
▶ দুগ্ধদানকারী মায়ের কাজে পরিবারের সব সদস্যকে সহযোগিতা করতে হবে।
▶ গর্ভবতী ও প্রসূতি মহিলাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পরিবারের সবার (স্বামী, শাশুড়ি) দায়িত্ব রয়েছে।
▶ গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের জন্য গর্ভবতীর সঙ্গে সেবাকেন্দ্রে যাওয়া এবং আয়রন ফলিক অ্যাসিড খাওয়ার জন্য গর্ভবতীকে মনে করিয়ে দেওয়া।
▶ গর্ভবতী মহিলা/দুগ্ধদানকারী মাকে অতিরিক্ত খাবার খেতে উৎসাহিত করা।
▶ ঘরের দৈনন্দিন টুকিটাকি কাজে গর্ভবতীকে সাহায্য করে তার কাজের বোঝা কমানো।
▶ হাসপাতালে প্রসব করানোর বিষয়ে গর্ভবতীকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগিতা করা।
▶ হাসপাতালে প্রসবের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেওয়া।
▶ জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য গর্ভবতীকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগিতা করা।
▶ জন্মের সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে মায়ের শাল দুধ খাওয়ানোর জন্য গর্ভবতীকে উৎসাহিত করা এবং সহযোগিতা করা।
▶ মা শিশুকে যথেষ্ট সময় নিয়ে দুধ খাওয়াতে পারে তার জন্য দুগ্ধদানকারী মাকে সুযোগ করে দেওয়া।
* গর্ভবতীর ৫টি বিপদ চিহ্ন
একজন গর্ভবতীর যে কোনো সময় যে কোনো বিপদ দেখা দিতে পারে। পরিবারের সবার গর্ভকালীন ৫টি বিপদ চিহ্ন সম্পর্কে জেনে রাখতে হবে এবং যে কোনো একটি দেখা দেওয়া মাত্র তাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। বিপদ লক্ষণগুলো হলো- রক্তক্ষরণ, প্রচণ্ড জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা এবং চোখে ঝাপসা দেখা, খিঁচুনি, অনেকক্ষণ ধরে প্রসব বেদনা/বিলম্বিত প্রসব (১২ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে থাকলে)।
* প্রসবকালীন বিপদ লক্ষণ
গর্ভবতীর প্রসবকালীন কিছু বিপদ দেখা দিতে পারে। এগুলো হলো- প্রসবের সময় মাথা ব্যতীত অন্য কোনো অঙ্গ বের হয়ে আসা, বিলম্বিত প্রসব, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি ও গর্ভফুল বের হতে বিলম্ব হওয়া।
* বাচ্চা প্রসবের আগে ও পরে কী কী সমস্যা হতে পারে
▶ গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সময়ে কোমর ও পিঠে ব্যথা (এ সময় পেট সামনের দিকে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কোমর ও পিঠের মেরুদণ্ড ও মাংসপেশিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে)।
▶ প্রসবকালীন সময়ে অধিক ব্যথা।
▶ গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা।
▶ প্রসবের আগে ও পরে পা ফুলে যাওয়া।
▶ সার্জারি পরবর্তী জটিলতা-কোমরের ইনজেকশনের জন্য ব্যথা।
▶ গাইনি সার্জারীর পর সেলাই স্থানে টান লাগা।
▶ প্রসব পরবর্তী কাশিতে প্রস্রাব ধরে রাখা কষ্টকর (অনেকের কাশির সঙ্গে দু’এক ফোঁটা প্রস্রাব বের হয়)।
* গর্ভবতীর রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসার উদ্দেশ্য
প্রসবের আগে ও পরে যাতে গর্ভবতীর কোনো ধরনের জটিলতা না হয় এজন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এগুলো হচ্ছে- প্রসব ত্বরান্বীতকরণ, প্রসবকালীন ব্যথা প্রশমন, কোমর ও পিঠে ব্যথা নিরাময়, সেলাই বা স্ট্রেস স্থানে টান কমানো, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা সমাধান, প্রসব পরবর্তী পেটের চর্বি কমানো ও প্রসবের পর পেলভিক ফ্লোর মাংসপেশি শক্তিশালী করা।
* রিহ্যাবিলিটেশন চিকিৎসা
▶ অ্যাকটিভ ও প্যাসিভ এক্সারসাইজের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করা।
▶ ফুসফুস’সহ শারীরিক সতকর্তার জন্য অ্যারোবিক এক্সারসাইজ করানো।
▶ গর্ভকালীন অবস্থায় পশ্চারাল উপদেশ দেওয়া।
▶ পেলভিক ফ্লোর মাংসপেশিকে স্ট্রেথিনিং এক্সারসাইজ করানো যাতে প্রস্রাব ঠিকমত ধরে রাখা যায়।
▶ পেটের মাংসপেশির ব্যায়াম করানো যাতে পেটের চর্বি কমে যায়।
▶ কোমর ও পিঠ ব্যথায় ম্যানুয়াল থেরাপি দেওয়া এবং সাপোর্টিভ বেল্ট ব্যবহার করানো।
▶ পা ফুলে গেলে রাতে শোয়ার পর পা বালিশে উঁচু করে রাখা যাতে ফোলা কমে যায় এবং থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ করানো।
▶ ব্যাক মাংসপেশি স্ট্রেংনিং এক্সারসাইজ করানো।
▶ ব্যথার জন্য স্পেসিফিক ইলেকট্রোথেরাপী ব্যবহার।
লেখক : ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিশেষজ্ঞ।