রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকার যানজট নিরসনে পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেল নেটওয়ার্কের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবের কথা মুখে বললেও এর উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তিনটি জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালান।
বিশেষ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রথম মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-৬) দুই অংশের উদ্বোধন করা হয় তড়িঘড়ি করে। তফসিল ঘোষণার সপ্তাহখানেক আগে ২০২৩ সালের ৫ নভেম্বর করা হয় একাংশের উদ্বোধন। আর বছরখানেক আগে আংশিক উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
ভবিষ্যৎ নির্বাচনের হিসাব কষে অন্য ৫টি লাইন নির্মাণেরও পরিকল্পনা করে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে প্রথম পাতালরেলসহ দুটি লাইনের ডিপোর ভূমি উন্নয়নে কিছু অগ্রগতি থাকলেও মূল কাজের দরপত্র এখনো প্রক্রিয়াধীন। আরেকটি লাইন পরিকল্পনা কমিশনে পড়ে আছে বছরের পর বছর। আর দুটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে দীর্ঘদিন।
এমআরটির ৬টি লাইন তৈরি করে ২০৩০ সালনাগাদ একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথা বলেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু একটি মেট্রোরেল নিয়ে উন্মাদনায় ব্যস্ত ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ফলে টানা সাড়ে ১৫ বছরে বাকি ৫টি লাইনই ছিল উপেক্ষিত, প্রকল্পের কাজ এগোয় কচ্ছপগতিতে।
মেগা প্রকল্প মেগা দুর্নীতি এবং এ ধরনের মেট্রো লাইন নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ব্যাপক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও মেট্রোরেল পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বলছে, মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরির লক্ষ্যে এমআরটি লাইনগুলো নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়ায় তা নতুন করে বিবেচনার সুযোগ নেই। তবে প্রকল্প ব্যয় ও অর্থের অপচয় কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) সূত্রমতে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৫ সালে তিনটি মেট্রোরেল নির্মাণসহ ২০ বছরমেয়াদি কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অত্যাধুনিক গণপরিবহন হিসেবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) বা মেট্রোরেল নেটওয়ার্ক তৈরির উদ্যোগ নেয়।
২০১৩ সালে ডিএমটিসিএল গঠন করে ৬টি লাইনের সমন্বয়ে ১৪০ দশমিক ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মেট্রো নেটওয়ার্ক ২০৩০ সালনাগাদ গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। এমআরটি লাইন-৬ উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পরিকল্পনা করা হলেও পরে কমলাপুর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এমআরটি লাইন-১ বিমানবন্দর থেকে বাড্ডা, মালিবাগ, রাজারবাগ দিয়ে কমলাপুর পর্যন্ত; আরেকটি রুট নতুনবাজার থেকে বোয়ালিয়া, পূর্বাচল হয়ে পিতলগঞ্জ ডিপো যাওয়ার কথা।
এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুটে হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার-গাবতলী হয়ে মিরপুর-কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান দিয়ে ভাটারা আর সাউদার্ন রুটে গাবতলী-টেকনিক্যাল, শ্যামলী-আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, কারওয়ান বাজার, হাতিরঝিল হয়ে আফতাবনগর দিয়ে নাসিরাবাদ-দাশেরকান্দিতে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা। এমআরটি লাইন-২ গাবতলী-বসিলা, সাতমসজিদ রোড, ঝিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আজিমপুর, শহীদ মিনার, গোলাপ শাহ মাজার, মতিঝিল, কমলাপুর-মুগদা দিয়ে চট্টগ্রাম রোড পর্যন্ত। এমআরটি লাইন-৪ কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। তার স্থানে গত ৯ সেপ্টেম্বর তার ডিএমটিসিএলের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে (চলতি) দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৬টি লাইনের সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে মোহাম্মদ আব্দুর রউফ আমার দেশকে বলেন, এমআরটির সবগুলো লাইনের কাজ চলমান। লাইন-৬-এর কাজ তো শেষ হয়েছে, বর্ধিত অংশের কাজও চলছে। তারপর লাইন-১-এর কাজ হচ্ছে। লাইন-৫-এর নর্দার্ন ও সাউদার্নের কাজ হচ্ছে। লাইন-২ ও ৪-এরও সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। কোনো লাইনই বন্ধ হচ্ছে না।
প্রথম মেট্রোরেল: এমআরটি লাইন-৬
২০০৯ সাল থেকে নানা প্রক্রিয়া শেষে ২০১২ সালে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। পরের বছর জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে তড়িঘড়ি করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে করা হয় এগুলো। ২০১৫ সালে মেট্রোরেল আইন সংসদে পাস হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এবং ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হয়। নির্বাচন সামনে রেখে উভয় ক্ষেত্রে ৬ মাস এগিয়ে তফসিল ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে এটি করে হাসিনা সরকার। ঢাকায় সুধী সমাবেশ করে নির্বাচনি প্রচার চালায় আওয়ামী লীগ।
মেট্রোরেলের কৃতিত্ব নিতে প্রতিবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনি পোস্টারে ছেয়ে যায় ঢাকাসহ সারা দেশ। পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনে প্রচুর বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হয়। তিনটি নির্বাচনেই দলের ইশতেহারে উন্নয়নের মাইলফলক হিসেবে তুলে ধরা হয় মেট্রোরেল। নৌকায় ভোট দিলে উন্নয়ন ও অনেকগুলো মেট্রোরেল হবে বলে একই প্রতিশ্রুতি বারবার দেন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই এমন অর্থের অপচয় করে প্রচার-প্রপাগান্ডা করা হয় বলে মনে করেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
এমআরটি লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক মো. জাকারিয়া আমার দেশকে বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধন আরও ৬ মাস পরে করলে আমাদের সুবিধা হতো, খুঁটিনাটি জিনিসগুলো আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু সরকার কী মনে করে উদ্বোধনের তারিখ এগিয়ে নিয়ে এসেছে, তা আমার জানা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা হয়নি।
এমআরটি লাইন-৬ উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটারের ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা অনুমোদন করা হয় শুরুতে। ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০২২ সালে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আরও ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার যোগ করে ২০২৫ সালে শেষ করার কথা বলা হয়। প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় দুবার সংশোধন করে করা হয় ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। ব্যয় বাড়ানোর হার ৫০ শতাংশেরও বেশি। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণেই ব্যয় এত বাড়ানো হয় বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের মেট্রো নেটওয়ার্কের পরিকল্পনা ছিল বিনিয়োগঘন। তারা মেগা প্রকল্পের ব্যাপারে অনেক বেশি আগ্রহী ছিল। এসব ছাড়াও যে উন্নয়ন করা যায়, তা চিন্তা করেনি। তার ওপর আবার পাতালরেলের দিকে গেছে, এর খরচ তিনগুণ বেশি, অপারেশনও তিনগুণ, উদ্বোধনের দিন থেকেই লাগবে আর্টিফিসিয়াল প্রযুক্তি। এক মেট্রোরেলেরই খরচের অর্ধেক উঠছে না। ফলে এই পুরো রূপকল্প ছিল বিলাসী। সেই সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
মেট্রোরেল মেরামত নিয়েও কেরামতি
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ১৮ জুলাই মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ এবং কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হলে এক মাসেরও বেশি সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। ২৭ জুলাই তখনকার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এক বছরেও মেট্রো স্টেশনগুলো চালু করা সম্ভব হবে না। ২০ জুলাই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডিএমটিসিএলের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন দুটি মেরামত করে চালু করতে এক বছরের মতো সময় লাগতে পারে। আর মেট্রোরেলের দুটি স্টেশনের মেরামতে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার।
তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশন বন্ধ রেখে ২৫ আগস্ট মেট্রোরেল পুনরায় চালু করে। মেরামত করে মাত্র দুই মাসের মাথায় ২০ সেপ্টেম্বর কাজীপাড়া স্টেশন এবং ২ মাস ২৭ দিন পর মিরপুর–১০ স্টেশনও চালু করা হয়। আর সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামতে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ স্টেশন মেরামত করতে প্রায় ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খরচের কথা বলা হয়।
এ বিষয়ে এমআরটি লাইন-৬-এর প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. জাকারিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বলেছিল এতদিন লাগবে, এত সময় লাগবে। কিন্তু আমরা সেটি কম সময়ে, কম খরচে করেছি। সরকার মিডিয়াতে যা বলেছিল, আমরা সেই সময়ের প্রতিবেদনে কিন্তু সেটি দিইনি। আমরা যথাযথভাবে প্রতিবেদনি করেছিলাম, সেটি পরিবর্তন করা হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে সেটি বাড়িয়ে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য আর সরকারের ভাষ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সে সময়ের সরকার হয়তো রাজনৈতিক কারণে বা জনগণের সহানুভূতি নেওয়ার জন্য বহু ক্ষয়ক্ষতির প্রপাগান্ডা করেছে।
ডিএমটিসিএল জানিয়েছে, ২০২৪ সালের শেষনাগাদ উত্তরা উত্তর হতে মতিঝিল পর্যন্ত অংশের বাস্তব গড় অগ্রগতি ৯৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত অংশের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। এ প্রকল্পের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেম সরবরাহ ও নির্মাণকাজ ৯৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ ৯৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং ডিএমটিসিএলের অফিস ব্যবস্থাপনা অটোমেশন করার এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইআরএমএস) সংগ্রহের এখনো আর্থিক মূল্যায়নের কাজ চলছে।
ডিএমটিসিএলের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা বলছেন, দেশের প্রথম মেট্রোরেল হিসেবে এমআরটি লাইন-৬কে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এটি সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায়ও স্থান পায়। সে হিসেবে বাকি পাঁচটি এমআরটি লাইনের নির্মাণকাজেও গুরুত্ব পাওয়ার কথা; কিন্তু তেমনটি ঘটেনি। ২০৩০ সাল নাগাদ ৬টি এমআরটি লাইনের সমন্বয়ে যে নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়, তা উপেক্ষিত হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে। এমআরটি লাইন-৬ তৈরি নিয়ে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয় যে, তাতে বাকিগুলো চাপা পড়ে যায়।
জাপানিরা ব্যয়বহুল জিনিস গছিয়ে দিয়েছে, আওয়ামী লীগও তাদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তা নিয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন মেরামতের সময় সেটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। পাতালরেলের প্রকল্পে অন্তর্বর্তী সরকারের এক ঝাঁকুনিতে ৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমে গেছে। তার মানে এর মধ্যে বাহুল্য খরচে ভরা, সবাই মিলে হরিলুট করতেই সেটা করা হয়েছে। মেট্রো নেটওয়ার্কের রূপকল্প যারা দিয়েছিলেন, তারা জনগণের সেবা দেওয়ার জন্য নয়—দেশটাকে ডোবাতে এসেছিলেন।
প্রথম পাতালরেলের কাজে ধীরগতি
দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেলের পর আওয়ামী লীগ সরকার এমআরটি লাইন-১ বা বাংলাদেশের প্রথম পাতাল ও উড়াল মেট্রোরেল নির্মাণে অগ্রাধিকার দেয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর ২০২৩ সালে এ প্রকল্পকে নিয়েও ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু করা হয়। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা আর এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি। এ সময় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও নৌকার পক্ষে রায় দিতে আহ্বান জানান এবং দিলে আরও এমন উন্নয়ন হবে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
বিমানবন্দর রুট ও পূর্বাচল রুট সমন্বয়ে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্প। প্রকল্পটি ২০২৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে জুলাই মাস পর্যন্ত পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়নের অগ্রগতি ছিল ৪৫ শতাংশ। বাকি কাজের দরপত্র আহ্বান কার্যক্রম বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন ছিল বলে ডিএমটিসিএলের প্রতিবেদনে বলা হয়। তবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পিতলগঞ্জ ডিপোর ভূমি উন্নয়নের অগ্রগতি ৮৭ শতাংশ হলেও বাকি কাজের দরপত্র এখনো প্রক্রিয়াধীন।
২০১৯ সালে একনেক ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে জাইকা প্রকল্প সহায়তা (পিএ) হিসেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি ৩২ লাখ টাকা দেবে এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় হবে ১৩ হাজার ১১১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
এমআরটি লাইন-৫ : নর্দার্ন রুট
এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন বাংলাদেশের দ্বিতীয় পাতাল মেট্রোরেল হওয়ার কথা। সাভারের হেমায়েতপুর থেকে রাজধানীর ভাটারা পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পাতাল এবং ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার উড়ালসহ মোট ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল লাইন তৈরি হবে। এর মাঝে যাত্রী ওঠানামার জন্য মোট ১৪টি স্টেশন (৯টি পাতাল ও ৫টি উড়াল) থাকবে এবং হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার ও ভাটারা অংশে মেট্রোরেলের উড়াল পথ হবে। গাবতলী থেকে নতুনবাজার অংশে পাতাল মেট্রোরেল হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এমআরটি লাইন-৬-এর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের উদ্বোধনের দিন এমআরটি লাইন-৫ নর্দার্ন রুটের নির্মাণকাজও উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন মতিঝিলের আরামবাগে আওয়ামী লীগ সুধী সমাবেশ করে আর এতেও বক্তব্য রাখেন তিনি। এ প্রকল্প নিয়েও ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালায় আওয়ামী লীগ।
৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ের এবং জাইকার ঋণ সহায়তায় এ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। প্রকল্পটি ২০২৮ সালে শেষ করার পরিকল্পনা থাকলেও তেমন একটা অগ্রগতি নেই। ডিএমটিসিএলের ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০টি প্যাকেজের মাধ্যমে এটি হেমায়েতপুর ডিপোর ভূমি উন্নয়নের অগ্রগতি ৩৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, বাকি প্যাকেজগুলোর দরপত্র বিভিন্ন পর্যায়ে প্রক্রিয়াধীন।
এমআরটি লাইন-৫ : সাউদার্ন রুট
২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৫ সাউদার্ন ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৫টি স্টেশন (পাতাল ১১টি ও উড়াল ৪টি) মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গাবতলী থেকে আফতাবনগর পশ্চিম পর্যন্ত ১৩ দশমিক ১০ কিলোমিটার পাতাল এবং আফতাবনগর সেন্টার থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার উড়াল লাইন হবে। ডিএমটিসিএলের জুলাইয়ের প্রতিবেদন বলছে, এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং প্রকৌশল নকশা শেষ হয়েছে। তার ভিত্তিতে প্রণীত বিনিয়োগ প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রক্রিয়াধীন।
এমআরটি লাইন-৪
২০৩০ সালের মধ্যে কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ জেলার মদনপুর পর্যন্ত উড়াল ও পাতাল সমন্বয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-৪ নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা গত বছরের ১৪ মে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে। ডিসেম্বরেও অবস্থা অপরিবর্তিত ছিল।
এমআরটি লাইন-২
এমআরটি লাইন-২ গাবতলী থেকে মোহাম্মদপুর-নিউমার্কেট হয়ে গুলিস্তান-কমলাপুর দিয়ে সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর পর্যন্ত মেইন লাইন এবং গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ব্রাঞ্চ লাইনের সমন্বয়ে উড়াল ও পাতাল লাইন নির্মাণ করার কথা। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোলাইন নির্মাণ শেষ করে ২০৩০ সালের মধ্যে নেটওয়ার্কে যুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা খোঁজা হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, এমআরটি লাইন-৬-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে শুরু করে উদ্বোধন পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিশাল অনুষ্ঠান করে অর্থের অপচয় করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল নৌকায় ভোট টানা, আওয়ামী লীগের বড় অর্জন হিসেবে দেখানো। অন্যদিকে ভারতে গঙ্গার তলদেশ দিয়ে করা মেট্রো রেল উদ্বোধনের সময় কয়েকটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। আর আমাদের একটা মেট্রোরেল উদ্বোধন করতে কী না করেছে শেখ হাসিনা সরকার।
সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মেট্রোরেল তৈরির কৃতিত্ব নেওয়ায় অর্থের অপচয়, লুটপাটের দায়ও নিতে হবে মন্তব্য করে মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ দামে আমাদের মেট্রোরেল কেনা হয়েছে। এর পেছনে ছিল লুটপাট। এখানে অর্থের যে অপচয় ও লুটপাট হয়েছে, তা না হলে অন্তত ৫টি লাইন আলোর মুখ দেখত। লাইন-৬-এর অর্থ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি মেট্রোরেল চালু করা সম্ভব হতো। ২০৩০ সাল নাগাদ মেট্রো নেটওয়ার্ক তৈরির কথা ছিল একটি আই ওয়াশমাত্র। ফলে অন্য লাইনগুলোর যাত্রীরা তাদের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।