ঝিনাইদহে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবির) ডিলার নবায়নে পতিত হাসিনা সরকারের পলাতক নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একাধিকবার তদন্ত করে তালিকা জেলা প্রশাসনে জমা দিলেও ঘুরেফিরে সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামই তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা ও উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভায় রীতিমত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কমিটির সাধারণ সদস্যরা।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত জুন মাসে টিসিবির দেওয়া ১২৪ জনের তালিকায় পলাতক, মৃত ব্যক্তি ও জুলাই আন্দোলনে হামলার আসামিরা ছিল। এটা নিয়ে আপত্তি উঠলে ঝিনাইদহ প্রশাসন নতুনভাবে তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্তের নামে আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রকৃত তথ্য গোপন করে ঘুরেফিরে সেই আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাকর্মীদের নাম তালিকায় জুড়ে দেন।
অভিযোগ রয়েছে, জেলার ৬টি উপজেলায় নতুন করে নবায়নের ১০৪ জন ডিলারের মধ্যে ৬৭ জনই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। এদের মধ্যে অনেকের নামে মামলা আছে এবং ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক রয়েছে। দ্বিতীয় দফায় তদন্ত করেও তাদের নাম কেন তালিকায় উঠল তা নিয়ে রীতিমত প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডে মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতা বীরেন শিকদারের চাচা কুমারেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। ৫নং ওয়ার্ডের ডিলার এনায়েত উল্লাহ তিন লাখ টাকায় তার ডিলারশিপ বিক্রি করে দিলেও তিনি তালিকায় রয়েছেন। সদরের মধুহাটী ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা খায়রুল ইসলামকে ডিলারশিপের সুপারিশ করা হয়েছে। ঝিনাইদহ পৌরসভার পাগলাকানাই ইউনিয়নে একই পরিবারে মেহেরিমা কাসেম ও আফরোজা খানমের নাম তালিকায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে। হরিশংকরপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতা কনক কান্তি দাসের ভাতিজা বিকাশ কুমার দাসের নাম রয়েছে। হরিণাকুন্ডুর কাপাশহাটীয়া ইউনিয়নে পতিত সরকারের এমপি সমির সিদ্দিকীর পিএস কামালের চাচা মামুন রশিদ ও চাঁদপুর ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা শরিফুলের নাম রয়েছে। নলডাঙ্গা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক এনামের আত্মীয় শওকত আলীর নাম সুপারিশ করা হয়েছে। কালীগঞ্জের সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সাবেক পৌর মেয়র পলাতক মোস্তাফিজুর রহমান বিজুর সহযোগী মোস্তাক আহম্মেদের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কালীগঞ্জ উপজেলায় টিসিবির ১৩ ডিলারের মধ্যে ১৩ জনই বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ঝিনাইদহ সদরে ৩৫ জনের মধ্যে ২৪ জন, হরিণাকুন্ডুতে ১৬ জনের মধ্যে ১১ জন, শৈলকূপায় ১৮ জনের মধ্যে ১১ জন ও মহেশপুরে ১৬ জনের মধ্যে ৬ জন পতিত সরকারের দোসর ও সমর্থকদের নাম রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে বিষয়খালী বাজারের এক মুদি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করেন, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিস সহকারী তার কাছ থেকে দুই হাজার টাকা ঘুষ নিয়েও তার নাম তালিকায় দেননি। একই উপজেলার চোরকোল বাজারের তরিকুল ও কলমনখালী বাজারের ইকবাল হোসেন ঘুষ দিয়েও নবায়নের তালিকায় তাদের নাম না থাকার অভিযোগ করেন।
অপরদিকে ঝিনাইদহ বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ বিশ্বাস ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা আবু হুরায়রা জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় টিসিবির ডিলারের তালিকায় পতিত সরকারের দোসরদের নাম থাকায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নেতৃদ্বয় জানান, গ্রামাঞ্চলে পতিত সরকারের লোকজন পণ্য বিক্রি করতে গেলে সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়তে পারে। এতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতা আবু হুরায়রা জেলায় টিসিবির সব ডিলারশিপ বাতিলের দাবি জানান। জবাবে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল সভাকক্ষে প্রকাশ্যে আশ্বস্ত করে জানান, প্রয়োজনে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা হবে। বিষয়টি নিয়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হোসনে আরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, একাধিক মহল থেকে অভিযোগ আসায় ইতিমধ্যে পুনঃতদন্তের জন্য তালিকা করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, ৯৮ জনের নাম যাচাই-বাছাই করার কাজ চলমান রয়েছে।